কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য মিলেছে

যশোরের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের হ্যাচারিতে বাচ্চা ফোটানো ও চাষ পদ্ধতির উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা
ছবি: প্রথম আলো

কৃত্রিম উপায়ে কাকিলা মাছের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোয় সফলতা এসেছে। বদ্ধ পরিবেশে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাচ্চা ফুটিয়ে সফলতা পেয়েছেন যশোরের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। উপকেন্দ্রটির হ্যাচারিতে কাকিলা মাছের প্রচুর বাচ্চা ফুটেছে। এসব বাচ্চাকে এখন চাষের উপযোগী পরিবেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

গত বৃহস্পতিবার যশোরের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, হ্যাচারির হাউসে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হচ্ছে। এক দিন বয়সের প্রচুর বাচ্চা ছোটাছুটি করছে হাউসের পানির নিচে। হাউসের ভেতরে পানির নিচে দেয়ালে প্রচুর ডিম লেগে আছে। এ সময় ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হতেও দেখা গেল।

যশোরের উপকেন্দ্রটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আউয়াল হোসেন বলেন, একই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দ্বিতীয় দফায় কাকিলা মাছের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়েছে। প্রথম দফায় সফলতা পাওয়ার পরে দ্বিতীয় দফায়ও সফলতা পাওয়া গেছে। তৃতীয় দফায় প্রজনন ঘটানোর পর প্রযুক্তিটা টেকসই বলে ধরে নেওয়া হয়। এখন চাষপদ্ধতি উদ্ভাবন করা হবে। তারপর কাকিলা মাছের বাণিজ্যিক চাষের জন্য কৃষক পর্যায়ে এই প্রযুক্তি নেওয়া হবে।

উপকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, স্বাদুপানির অভ্যন্তরীণ নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল ইত্যাদি জলাশয়ে যেসব মাছ পাওয়া যায়, এর মধ্যে কাকিলা অন্যতম। খেতে সুস্বাদু এই মাছের দোপেঁয়াজি ভোজন রসিকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। মানবদেহের জন্য উপকারী অনুপুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ ও কাটা কম হওয়ায় সবার কাছে এই মাছ প্রিয়। একসময় অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে এই মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মানবসৃষ্ট নানা কারণে বাসস্থান ও প্রজননক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কাকিলার প্রাপ্যতা ব্যাপক কমে গেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, আবার কাকিলা মাছ সহজপ্রাপ্য হবে।

তিন বছর নিবিড় গবেষণার পর এই সফলতা পান মৎস্যবিজ্ঞানীরা। এই গবেষণায় নিযুক্ত আছেন উপকেন্দ্রটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আউয়াল হোসেন, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিশির কুমার দে।

হ্যাচারিতে বাচ্চা ফোটানো ও চাষ পদ্ধতির উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা
ছবি: প্রথম আলো

গবেষকদের ভাষ্য, কাকিলা বিলুপ্তপ্রায় মাছ। এর দেহ সরু, ঠোঁট লম্বাটে ও দাঁত ধারালো। বাংলাদেশে যে জাতটি পাওয়া যায় সেটি মিঠাপানির জাত। মাছটি বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে ‘কাইকল্যা’, ‘কাইক্কা’ নামেই বেশি পরিচিত। বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে এই মাছ পাওয়া যায়। তবে রং ও আকারে কিছু পার্থক্য আছে।

গবেষণা দলের প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আউয়াল হোসেন বলেন, কাকিলার দেহ লম্বা ও সামান্য চাপা এবং প্রায় সিলিন্ডার আকৃতির। এগুলো লম্বায় ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার হয়। পরিণত পুরুষ মাছের মাথার শীর্ষে লাল চূড়া দেখতে পাওয়া যায়, যা থেকে সহজেই স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা করা যায়। পুরুষ মাছের দেহ স্ত্রী মাছের তুলনায় বেশি সরু ও আকারে একটু ছোট হয়। এটি শিকারি মাছ। মূলত এই মাছ তুলনামূলক ছোট মাছ খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকে।প্রাকৃতিকভাবে প্রবহমান জলাশয়ে বিশেষ করে নদীতে এবং বর্ষাকালে প্লাবিত অঞ্চলে প্রজনন করে। পরিণত মাছেরা ভাসমান জলজ উদ্ভিদ নেই এমন স্থানে বসবাস করলেও জলজ উদ্ভিদের পাতার নিচে ও ভাসমান শিকড়ে এদের স্ত্রীরা ডিম পাড়ে। কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজনন এটিই বাংলাদেশে প্রথম এবং বিশ্বের কোথাও এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

বিএফআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা বিশ্বে প্রথম কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা লাভ করেছেন। এতে বিলুপ্তির হাত থেকে মাছটি রক্ষা পাবে।
আনিছুর রহমান, যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা

গবেষকেরা জানিয়েছেন, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী কাকিলা মাছে ১৭ দশমিক ১ শতাংশ আমিষ, লিপিড ২ দশমিক ২৩ শতাংশ, ফসফরাস ২ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ ক্যালসিয়াম আছে, যা অন্যান্য ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি।

গবেষক দলের সদস্য ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, রাজবাড়ী জেলাসংলগ্ন কুষ্টিয়ার পদ্মা নদী থেকে কাকিলা ব্রুড (মা-বাবা মাছ) মাছ সংগ্রহ করে বিশেষ পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে যশোরের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের পুকুরে ছাড়া হয়। পরে হ্যাচারিতে উৎপাদিত কার্পজাতীয় মাছের জীবিত পোনা এবং নানা জলাশয় থেকে সংগৃহীত জীবিত ছোট মাছ খাইয়ে পুকুরের আবদ্ধ পরিবেশে মাছকে অভ্যস্ত করা হয়। এরপর চলতি বছরের মে মাস থেকে বৈজ্ঞানিক প্রটোকল অনুসরণ করে কৃত্রিম প্রজননের উদ্দেশ্যে উপকেন্দ্রের হ্যাচারিতে নির্দিষ্টসংখ্যক বাবা ও মা মাছকে বিভিন্ন ডোজে হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। এভাবে কয়েকবার বিভিন্ন ডোজের ট্রায়াল দেওয়া হলেও মাছের প্রজননে সফলতা আসেনি। অবশেষে ২৫ আগস্ট প্রজনন করা কাকিলা মাছের ডিম থেকে পোনা বের হয়। তখন কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা আসে। অন্তত ১ হাজার ২০০ ব্রুড মাছ সংগ্রহ করে গবেষণা চালানো হচ্ছে।

যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, বিএফআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা বিশ্বে প্রথম কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা লাভ করেছেন। এতে বিলুপ্তির হাত থেকে মাছটি রক্ষা পাবে। এখন পুকুরে চাষপদ্ধতি উদ্ভাবন করে চাষের আওতায় নিয়ে এলে দেশবাসী আবার সুস্বাদু মাছটির স্বাদ নিতে পারবে।