‘কাগুজে’ নাগরিক সেবার সঙ্গে বাস্তবে ফারাক

রংপুর নগরের বিভিন্ন সড়ক বেহাল। সম্প্রতি নগরের পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের সামনে।
ছবি: মঈনুল ইসলাম

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান সেবাগুলোর একটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। কিন্তু নগরের অনেক এলাকা এখনো সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আওতার বাইরে। অথচ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে করা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে বলছে, তারা নগরের ৯৮ শতাংশ এলাকা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে এসেছে।

শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন কাগজপত্রে নিজেদের কার্যক্রম যতটা দেখাচ্ছে, বাস্তবে নাগরিকেরা ততটা সেবা পাচ্ছেন না। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) হয় এক বছরের জন্য। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এক বছরের কার্যক্রমকেই আমলে নেওয়া হয়। এর সঙ্গে সিটি করপোরেশনগুলোর সার্বিক সেবার মানের বিষয়টি যুক্ত না।

অধীনস্থ ২০টি সংস্থার সঙ্গে এপিএ স্বাক্ষর করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তাতে সংস্থাগুলো এক বছরের কী কী কাজ সম্পাদন করবে সেটি উল্লেখ থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে করা চুক্তির মূল্যায়ন করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। দেখা যাচ্ছে, ১০০ নম্বরের মধ্যে প্রাপ্ত নম্বরের দিক থেকে বেশির ভাগ সিটি করপোরেশনের অবস্থান নিচের দিকে। তালিকায় ১৬ থেকে ২০তম স্থানে রয়েছে ৫টি সিটি করপোরেশন। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন। প্রথম হয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।

সিটি করপোরেশনগুলোর নাগরিক সেবার বিষয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সরেজমিনে ও নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলা হয়। কাগজে–কলমে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার, নালা সংস্কার, পরিচ্ছন্নতা, সড়ক বাতি স্থাপন, মাঠ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি দেখানো হলেও সিটি করপোরেশনের এসব সেবা নিয়ে নগরবাসী খুব একটা সন্তুষ্ট নন। বছরের অধিকাংশ সময় সড়কের বেহাল অবস্থা, সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন দুর্ভোগে ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের।

কর্মসম্পাদন চুক্তি ও এর মূল্যায়নের পুরো বিষয়টিকে ‘কাগুজে অনুশীলন’ বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই চুক্তির মাধ্যমে বাস্তবিক পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন হচ্ছে না। কাজের গুণগত মানের কোনো মূল্যায়ন নেই। কেউ বলছে, শতভাগ বর্জ্য পরিচ্ছন্ন করছে, বাস্তবচিত্র দেখা হচ্ছে না। ফলে চুক্তির ফলাফলের সঙ্গে নাগরিক সেবার মিল পাওয়া যায় না।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কর্মসম্পাদন চুক্তিতে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৮৭ নম্বর পেয়ে নবম হয়েছে। এই সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের বাসিন্দারা বছরের পর বছর পৌরকর পরিশোধ করেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ওয়ার্ডের কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা গাজী মঈনউদ্দিন বলেন, বর্জ্য নেওয়ার জন্য সিটি করপোরেশন থেকে কেউ আসেন না। এলাকার মানুষ যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলেন।

রংপুর সিটি করপোরেশনের কর্মসম্পাদন চুক্তিতে ৬২ কিলোমিটার পাকা সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিশ্রুতি ছিল, রংপুর সিটি করপোরেশন শতভাগ অর্জন দেখিয়েছে। অথচ সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ সড়ক এবড়োখেবড়ো, খানাখন্দে ভরা। রংপুর সিটি করপোরেশন ৪০ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণের প্রতিশ্রুতির শতভাগ বাস্তবায়ন দেখিয়েছে। বাস্তবে অনেক এলাকা নর্দমা নির্মাণের জন্য খুঁড়ে রাখা হলেও কাজ শেষ হয়নি। রংপুর সিটির মেয়র মোস্তাফিজার রহমান বলেন, চুক্তি অনুযায়ী শতভাগ কাজ না হলেও কিছুটা কম হয়েছে।

সেবার মান যাচাইয়ের সুযোগ ছিল না

সিটি করপোরেশনগুলোর সঙ্গে বার্ষিক চুক্তির কৌশলগত উদ্দেশ্য ছিল পরিকল্পিত, টেকসই ও নিরাপদ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি আধুনিকায়ন, উন্মুক্ত স্থানসমূহের উন্নয়ন ও সবুজায়ন। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা এবং আয় বাড়ানো। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

এই চুক্তির মাধ্যমে বাস্তবিক পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন হচ্ছে না। কাজের গুণগত মানের কোনো মূল্যায়ন নেই। কেউ বলছে, শতভাগ বর্জ্য পরিচ্ছন্ন করছে, বাস্তবচিত্র দেখা হচ্ছে না। ফলে চুক্তির ফলাফলের সঙ্গে নাগরিক সেবার মিল পাওয়া যায় না।
তোফায়েল আহমেদ, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ

স্থানীয় সরকার বিভাগের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি মূল্যায়নে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। এই কমিটির আহ্বায়ক স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন)। কমিটির বাকি সদস্যরাও স্থানীয় সরকার বিভাগের বিভিন্ন পদে কর্মরত। কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির পক্ষে সরাসরি গিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বা সেবার মান যাচাই করার সুযোগ ছিল না। সংস্থাগুলোর জমা দেওয়া কাগজপত্র ও প্রমাণাদির ভিত্তিতে কমিটি মূল্যায়ন করেছে। এমন চুক্তির ফলে নাগরিক সেবার মান উন্নয়ন হচ্ছে কী না সেটি যাচাইবাছাই করার সুযোগ কমিটির নেই।

চুক্তি অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৫টি পার্ক, নয়টি মাঠ উন্নয়ন করার কথা ছিল। দুটি আধুনিক পশু জবাইখানা নির্মাণের লক্ষ্য ছিল। তবে এগুলোর কাজ শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি। ফুটপাত সংস্কার করা হলেও বেশ কিছু এলাকার ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে থাকায় পথচারীরা হাঁটতে পারেন না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১০টি পার্ক ও দুটি খেলার মাঠ উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু শেষ হয়েছে মাত্র দুটি পার্ক ও একটি মাঠের কাজ। অন্যান্য চলমান কাজের অগ্রগতি কোনোটির ৫ শতাংশ, কোনোটির আবার ৬০-৭০ ভাগ।

বৃষ্টি হলে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বঙ্গবন্ধু সড়কে পানি জমে জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। নগরের শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাত হকারের দখলে থাকায় পথচারীদের চলাচলেও ভোগান্তি পোহাতে হয়।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের অশোকতলা ভারুলবাড়ি এলাকার প্রধান সড়কটি এক বছর আগে সংস্কার করা হয়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সড়কে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর বলেন, করপোরেশনের কাজের মান সন্তোষজনক নয়।

সামগ্রিক সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ততা কম

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১০টি পার্ক ও দুটি খেলার মাঠ উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু শেষ হয়েছে মাত্র দুটি পার্ক ও একটি মাঠের কাজ। অন্যান্য চলমান কাজের অগ্রগতি কোনোটির ৫ শতাংশ, কোনোটির আবার ৬০-৭০ ভাগ।

চুক্তি অনুযায়ী ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৪৪ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের কথা ছিল। সিটি করপোরেশন ২৫ কিলোমিটার সড়ক পাকা করেছে। ৪৪ কিলোমিটার নর্দমা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ছিল। বাস্তবায়ন হয়েছে ১৭ দশমিক ৩২৬ কিলোমিটার। নগরবাসীর অভিযোগ, সিটি করপোরেশন হওয়ার এক বছর পার হলেও কোনো কোনো এলাকার সড়ক ন্যূনতম সংস্কার হয়নি।

কর্মসম্পাদন চুক্তিতে ৯৪ দশমিক ৫২ নম্বর পেয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন। কিন্তু এই সিটির বেশ কিছু সড়ক চলাচলের অনুপযোগী।

স্থানীয় সরকার বিভাগের এপিএ মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) দীপক চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কর্মসম্পাদন চুক্তির কিছু সূচক দেওয়া আছে, এর ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। সিটি করপোরেশনের সামগ্রিক নাগরিক সেবার সঙ্গে এই চুক্তির সম্পৃক্ততা কম। কাগজপত্রে সংস্থাগুলো বলছে, তারা সেবা দিচ্ছে, কিন্তু সেটি কতটা মানসম্মত তা নাগরিকেরাই বলতে পারবেন।

তলানিতে বরিশাল, সিলেট এগিয়ে

২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বাস্তবায়নে ২০টি সংস্থার মধ্যে তলানিতে রয়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশন। বিভিন্ন ওয়ার্ডে ২০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ২৫ কিলোমিটার সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা। কিন্তু তা হয়নি। বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাইল হোসেন বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের অশোকতলা ভারুলবাড়ি এলাকার প্রধান সড়কটি এক বছর আগে সংস্কার করা হয়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সড়কে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর বলেন, করপোরেশনের কাজের মান সন্তোষজনক নয়।

চুক্তি বাস্তবায়নের দিক থেকে সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে প্রথম হয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন। চলতি অর্থবছরের কর্মসম্পাদন চুক্তির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূল্যায়ন কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) দীপক চক্রবর্তী বলেন, চলতি বছর থেকে সরাসরি মাঠে গিয়ে কার্যক্রম পরিদর্শন করার পরে ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন করা হবে। ফলে কাগজপত্রের পাশাপাশি সরেজমিন চিত্রও দেখা হবে।

তবে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, কর্মসম্পাদন চুক্তির বিষয়টি গতানুগতিকতায় আটকা পরেছে। চুক্তি করার আগেই অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সামর্থ্য অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার পরে সেটি কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে তা দেখভালের জন্য সরকারের নিজস্ব পদ্ধতি থাকতে হবে। স্বাধীন কোনো সংস্থা দিয়ে এই মূল্যায়ন করাতে হবে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদকপ্রতিনিধিরা)