কাজুবাদামে সাফল্যের গল্প

বাংলাদেশে এই প্রথম কাজুবাদামের সমন্বিত কারখানা। গত বৃহস্পতিবার বেলা একটায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ডেইল পাড়া এলাকায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
বাংলাদেশে এই প্রথম কাজুবাদামের সমন্বিত কারখানা। গত বৃহস্পতিবার বেলা একটায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ডেইল পাড়া এলাকায়। ছবি: সৌরভ দাশ

এক দশক আগেও কাঁচা কাজুবাদাম ছিল ফেলনা। পাহাড়িদের কেউ কেউ তা কুড়িয়ে খোসা ছাড়িয়ে বিক্রি করত। ২০১০ সালে বান্দরবানে বেড়াতে গিয়ে এই বাদাম দেখে অবাক হন শাকিল আহমেদ। বাগান থেকে কুড়িয়ে নেওয়ার খরচ দিয়ে দুই ট্রাক কাঁচা বাদাম চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। পরে সিঙ্গাপুরে পরিচিত একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সহায়তায় রপ্তানিও করেন ভারতে। প্রথম চালান হাতে পেয়ে বিদেশি ক্রেতা সাফ জানিয়ে দেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কাজুবাদাম রপ্তানি হবে না। এগুলো রপ্তানির কথা ভুলে যাও।’ ব্যর্থতার এমন কাহিনি দিয়ে শুরু হয়েছিল দেশের প্রথম কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতের সমন্বিত কারখানা গড়ে তোলার পেছনের গল্প।

২০১৬ সালের জুনে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ডেইলপাড়ায় ‘গ্রিনগ্রেইন কেশিও প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি’ নামে কারখানা গড়ে তোলেন শাকিল আহমেদ। সঙ্গে ছিলেন সহ–উদ্যোক্তা ইকরাম মোরশেদ। শুরুতে মাত্র ১০ জন কর্মী নিয়ে কাজ শুরু করেন। এখন কারখানায় কাজ করছেন ৬৫ জন, যাঁদের ৫৫ জনই নারী কর্মী। উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে এই সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতিদিন এই কারখানা থেকে বড় বড় হোটেল–রেস্তোরাঁয় যাচ্ছে প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম। দেশ থেকে প্রথমবারের মতো রপ্তানিও হচ্ছে এই কারখানার বাদাম।

কারখানার উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ প্রথম আলোকে জানান, কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করার বড় কারখানা হতে পারে, তা কারও ধারণায় ছিল না। পাগলামি বলে উড়িয়ে দিয়েছিল অনেকে। কারখানা করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছেন। দমে যাননি। এই উদ্যোগের কথা জেনে কৃষি মন্ত্রণালয়ও এখন সহযোগিতা করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির স্বপ্ন পূরণ হতে পারে এই কাজুবাদামে। কাজুবাদামের কারখানা শ্রমনির্ভর হওয়ায় কর্মসংস্থানেরও সুযোগ আছে। ভিয়েতনামের চেয়ে এখানে শ্রমিকদের মজুরি কম।

কাঁচা বাদাম রপ্তানি দিয়ে শুরু

উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সুইডেনের সেন্টন এবি কোম্পানির সফটওয়্যার ডেভেলপারের চাকরি ছেড়েছেন তিনি। বিশ্বখ্যাত ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেও মন বসছিল না তাঁর। আবার রপ্তানির শুরুতেও ছিল ব্যর্থতার গল্প। সেখান থেকে কীভাবে সাফল্যের দেখা মিলল? চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ডেইলপাড়ার কারখানায় যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে গল্প শোনালেন শাকিল আহমেদ। বললেন, ‘প্রথমবার হতাশ হয়ে গেলাম। দমে না গিয়ে কাজুবাদামের বাণিজ্য নিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। কারখানার সহ–উদ্যোক্তা ইকরাম মোরশেদ ২০১৪ সালে পাহাড় থেকে আনা কাঁচা কাজুবাদাম বিক্রি হচ্ছে বলে খবর দেন। তা দেখে কিনে নিই। এবার আবার ভারতে রপ্তানির জন্য সিঙ্গাপুরের ওই পরিচিত ব্যবসায়ীর দ্বারস্থ হই। বিনা মূল্যে দিলেও তারা নেবে না বলে জানিয়ে দেয়। রাজি করাতে না পেরে অন্তত চট্টগ্রামে এসে সরেজমিনে দেখার অনুরোধ জানাই।’

তাঁর পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত ভারতের কেরালার কল্যাম থেকে কাজুবাদাম বিশেষজ্ঞ নন্দকুমার এক দিনের জন্য চট্টগ্রামে আসেন। মাঝিরঘাটে গুদামে একটানা তিন ঘণ্টা কাঁচা কাজুবাদাম পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখেন। পরীক্ষার পর হাততালি দিয়ে নন্দকুমার বলেন, ‘কিছুটা হবে এবার।’ তখনই নন্দকুমারের পরামর্শ অনুযায়ী বড় ও ছোট দানা আলাদা করা হলো। বড় দানা ভিয়েতনামে ও ছোট দানা ভারতে রপ্তানির জন্য ঠিক হলো। কিন্তু সমস্যা বাধল, এই বাদামও দুই দেশের কোনো ক্রেতাই নিতে চায় না।

শেষ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানটি ঝুঁকি নেয়। বাদাম পাওয়ার পর ভিয়েতনাম থেকে প্রথম সুখবর এল। এরপরই পাহাড় থেকে কাজুবাদাম কিনে রপ্তানি করতে থাকেন তিনি। ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া কাঁচা কাজুবাদামের ৭৫ শতাংশ বা ১২ লাখ ২৩ হাজার ডলার রপ্তানি আয় আসে তাঁর হাত ধরে।

প্রতিটি বাদামে হাতের ছোঁয়া

গল্প শুনতে শুনতে গাড়ি এসে থামে পতেঙ্গার ডেইলপাড়ায় গ্রিনগ্রেইন কেশিও প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজের সামনে। সেখানে ভেতরে চলছে কর্মযজ্ঞ। প্রথম শেডে মেশিনে ছোট–বড় দানা আলাদা করে পানির বাষ্পে সেদ্ধ করা হচ্ছে। ঠান্ডা হওয়ার পর কারখানার আরেক শেডে নারী কর্মীরা একমনে বাদাম প্রক্রিয়াজাতের কাজ করছেন। প্রথম সারিতে একদল নারী কর্মী হস্তচালিত যন্ত্রে প্রতিটি বাদামের খোসা ভেঙে চলেছেন। এই খোসা টেবিলের ওপর আরেক দলের সামনে রাখা হচ্ছে। সেখানে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে খোসা ছাড়িয়ে শুধু বাদাম আলাদা করা হচ্ছে। আলাদা করা বাদামের ওপর তখনো ডোরাকাটা হালকা আবরণ। এই হালকা আবরণ আলাদা করার জন্য আবার বিশেষায়িত যন্ত্রে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখা হচ্ছে। পরের ধাপে আবার কর্মীরা হাতে এই আবরণ ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। এরপর সাদা কাজুবাদাম আলাদা করে প্যাকেটজাত করা হচ্ছে।

শাকিল আহমেদ।  ছবি: প্রথম আলো
শাকিল আহমেদ। ছবি: প্রথম আলো

কারখানার নারী কর্মী মৌসুমী আক্তার বলেন, ‘২০১৬ সাল থেকেই কাজ করছি। কাজের পরিবেশ ভালো।’ আরেক নারী কর্মী নাসরিন বেগম জানান, এখানে কাজে খুব বেশি চাপ নেই।

কারখানার সহ–উদ্যোক্তা ইকরাম মোরশেদ বললেন, কারখানায় শুধু বাদামই নয়, বাদামের খোসা প্রক্রিয়াজাত করে তেল বের করার যন্ত্রপাতিও আনা হয়েছে। তাতে যে তেল পাওয়া যাবে, তা এনামেল পেইন্টে ব্যবহার করা যায়। রপ্তানিরও সুযোগ আছে। আবার তেল পাওয়ার পর খোসার গুঁড়া জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এখন বাদামের কোনো কিছুই আর ফেলনা নয়।

বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির স্বপ্ন

বিশ্বে গত বছর কাজুবাদাম রপ্তানির বাজার ছিল প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার। এর ৬০ শতাংশই বা ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে ভিয়েতনাম। ২০৩০ সালে সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির স্বপ্ন দেখছে তারা। অথচ ১৯৮৮ সালে দেশটি প্রথম কাজুবাদাম চাষ শুরু করে। অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়তে থাকায় তাদের রপ্তানি কমছে।

দেশে কাজুবাদাম আমদানি হয় পুরোটাই ভিয়েতনাম থেকে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত বছর ৬ লাখ ৮০ হাজার কেজি কাজুবাদাম আমদানি হয়, যার বাজারমূল্য ৭০ কোটি টাকা। প্রক্রিয়াজাত কারখানা না থাকায় শুরুতে কাঁচা বাদাম রপ্তানিই ছিল ভরসা। রপ্তানির পর বিদেশের কারখানায় প্রক্রিয়াজাত বাদামই আবার উচ্চ মূল্যে আমদানি হয়।

কাজুবাদামের উৎপাদন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’–এর পরিচালক মেহেদী মাসুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বাণিজ্যিক কৃষি উন্নয়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করছে। প্রক্রিয়াজাত কারখানার উদ্যোক্তারা তাতে পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন। এতে যেমন কাঁচা কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করে দেশের চাহিদা মেটানো যাবে, তেমনি রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন খাত তৈরি হবে।