কাজে ঢিলেমি, চিন্তায় কৃষক

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ না হলে অকাল বন্যায় ফসলহানির আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।

দিরাই উপজেলার বরাম হাওরে একটি ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হচ্ছে। হাওরের কাদিরপুর এলাকায় গত শনিবার
ছবি: প্রথম আলো

সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য সময় দেওয়া হয় ৭৫ দিন। এ বছর নির্ধারিত সময়ের ৬৩ দিনই চলে গেছে। হাতে সময় আছে আর মাত্র ১২ দিন। অথচ এখনো কাগজে-কলমেই কাজের অর্ধেকটা বাকি আছে।

কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতারা বলছেন, প্রকল্প নির্ধারণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন থেকে শুরু করে এবার প্রতিটি ধাপে বাঁধের কাজে পাউবো ও প্রশাসনের মধ্যে তাঁরা একটা সমন্বয়হীনতা দেখেছেন। রয়েছে গাফিলতি ও নানা অনিয়ম। এখনো কিছু কিছু প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি। আবার কোথাও কোথাও নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেছেন, এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি গড়ে ৫২ শতাংশ। সব প্রকল্পে কাজ শুরু হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে। তবে এবার পানি কিছুটা দেরিতে নামায় অনেক জায়গায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করা যায়নি। সমন্বয়হীনতা ও অনিয়ম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটা সঠিক নয়, কাজের জন্য জেলা ও উপজেলা কমিটি রয়েছে। সবার সমন্বয়েই কাজ হচ্ছে।’

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয় গত ১৫ ডিসেম্বর। কাজ শেষ করার সময় ২৮ ফেব্রুয়ারি। এবার ৬১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কাজ হবে। এ জন্য ৭৭৯টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য আলাদা পিআইসি গঠন করা হয়েছে। এবার বাঁধের কাজে দরকার ১২৭ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৬২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

জেলার দিরাই উপজেলায় ১২০টি প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। গত শনিবার উপজেলার বরাম হাওরের কাদিরপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে তিনটি প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। এই হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এটি। এখানে ৯৪ নম্বর প্রকল্পে কাজ শুরু হয়েছে শনিবার থেকে। ২০ জন শ্রমিক পাশের জমি থেকে মাটি তুলে বাঁধের কাজ করছেন।

পাশের ৯৫ নম্বর প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, এটি নদীর একেবারে তীরে অবস্থিত। সেখানে কর্মরত শ্রমিক শাহজাহান বলেন, স্থানটি গভীর হওয়ায় মাটি বেশি লাগে। তবে মূল অংশে মাটি ফেলা হয়েছে। এই কাজ শেষ হতে আরও ১৫ দিন লাগতে পারে। এই প্রকল্পের সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, প্রথম দিকে ট্রাক কম ছিল, এখন ট্রাক বাড়ানো হয়েছে। কাজ শেষ হতে বেশি দিন লাগবে না।

কাদিরপুর গ্রামের পূর্বপাশের পাকা রাস্তা ধরে কাজ হচ্ছে ৯৩ নম্বর প্রকল্পের। গ্রামের পাশের পাকা রাস্তার ওপর ফেলে রাখা হয়েছে মাটি। এ প্রসঙ্গে গ্রামের এক ব্যক্তি জানালেন, এখানে এর আগে কখনো বাঁধের কাজ হয়নি। এই অংশ দিয়ে নদীর তীর উপচে হাওরে ঢলের পানি ঢুকতে পারে, এ জন্য এবার বাঁধ হচ্ছে। তবে এখানে বাঁধ না হলেও চলত। প্রকল্পের পাশে রাখা সাইনবোর্ডে প্রকল্পের সভাপতি হিসেবে গ্রামের বাসিন্দা নিয়ামত আলীর নাম রয়েছে। নামের পাশে দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে ফোন করলে তাড়ল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও নিয়ামত আলীর স্ত্রী পরিচয় দিয়ে সালমা বেগম বলেন, কাজের তদারকি তিনিই করছেন। রাস্তার ওপর নয়, বাঁধ হবে রাস্তার পাশে। আপাতত মাটি রাস্তার ওপর রাখা হয়েছে। পরে নির্ধারিত স্থানে ফেলা হবে।

বরাম হাওরে ১০ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন কাদিরপুর গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দিন (৫০)। তিনি বলেন, আর কদিন পর বৃষ্টি শুরু হবে। অসময়ে বাঁধের কাজ হলে বাঁধ দুর্বল হয়। আর দুর্বল বাঁধ ঢলের পানির প্রথম ধাক্কাতেই ভেঙে যায়। একই গ্রামের কৃষক রহিছ আলী (৮০) তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, হাওরে তিন-চার বছর পরপর আগাম বন্যা হয়। গত তিন বছর সেটি হয়নি, তাই এবার আশঙ্কা আছে। বাঁধের কাজ ভালোভাবে না হলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে।

দিরাইয়ের মতো জেলার সব হাওরের কাজেই ধীরগতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলনের’ নেতারা। উপজেলার হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে কুদরত পাশা বলেছেন, গত ১০ দিনে এই উপজেলার ৩২টি বাঁধের কাজ পরিদর্শন করেছেন তাঁরা। বাঁধের কাজ কোথাও ৩০ ভাগের ওপরে হয়নি। এখন বাকি ১২ দিনে ৭০ শতাংশ কাজ শেষ করা সম্ভব নয়।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, গত এক সপ্তাহে জেলার ৫০টির মতো বাঁধের কাজ পরিদর্শন করেছেন তাঁরা। কোনো কোনো বাঁধে ১৫, আবার কোথাও ৪০ শতাংশ কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতি সুনামগঞ্জে অতীতে হয়নি। তাই প্রশাসন ও পাউবো কর্মকর্তাদের তদারকি বাড়াতে হবে। অন্যথায় এবার সুনামগঞ্জবাসীর কপালে দুঃখ আছে।