কারাদণ্ড ভোগ করা ৩১ দিন আসামির দণ্ড হিসেবে গণ্য করলেন আপিল বিভাগ

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

তিন দশকের বেশি সময় আগে মারপিটের অভিযোগে জয়দেবপুরের এক মামলায় নূর মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তির তিন আদালতের রায়ে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এই ব্যক্তি ৩১ দিন কারাদণ্ড ভোগ করেন। এই ৩১ দিনই তাঁর দণ্ড হিসেবে গণ্য হবে বলে রায়ে বলেছেন সর্বোচ্চ আদালত।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নূর মোহাম্মদের করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের ভার্চ্যুয়াল আপিল বেঞ্চ গত ২৮ জানুয়ারি ওই রায় দেন। হাইকোর্ট বিভাগের রায় ও আদেশ সংশোধন করে আপিল বিভাগের বাংলায় লেখা আট পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি আজ মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।

রায়ের শেষাংশে বলা হয়, এখানে দেখা যাচ্ছে নিম্ন আদালতের দুজন বিচারক এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক কেউই দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ বা আপস মীমাংসার ব্যাপারে চিন্তা করেননি এবং দণ্ড ও সাজা বহাল রাখেন। ইতিমধ্যে আবেদনকারী নূর মোহাম্মদ ৩১ দিন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন।

অভিমতে আদালত বলেছেন, নূর মোহাম্মদের দোষী সাব্যস্তের আদেশ এবং জরিমানা বহাল থাকবে। তবে তিনি যত দিন কারাভোগ করেছেন, তত দিনই তাঁর দণ্ড হিসেবে গণ্য হবে।

রায়ে আদালত বলেছেন, ‘আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, বিচারিক আদালতের বিচারক ও আপিল আদালতের বিচারক সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন যে আমাদের দেশে দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ নামে একটি আইন আছে। বর্তমান মামলার প্রেক্ষাপটে সেই আইনের ৫ ধারা প্রয়োগযোগ্য। মামলার বিষয়বস্তু থেকে প্রতীয়মান হয় যে এই ঘটনা ঘটেছিল দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে।

এসব ক্ষেত্রে আসামিকে এক বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচীন ছিল। যেহেতু দণ্ডবিধির ৩২৩ ও ৩২৫ ধারা আপসযোগ্য অপরাধ এবং দুই পক্ষ হচ্ছে পরস্পর আত্মীয়/প্রতিবেশী কাজেই মামলাটি আপস মীমাংসা যুক্তিযুক্ত ছিল।

রায়ে বলা হয়, ওই অর্ডিন্যান্সের বিধানাবলি বিচারিক আদালত, আপিল আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রয়োগযোগ্য। অথচ আগের আদালতগুলোর তিনটি রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে বিচারকগণ এই আইনের বিষয়ে আদৌ অবগত আছেন কি না। যদি এই আইন প্রয়োগের বিষয়ে ধারণা থাকত, তাহলে রায়ে বলা থাকত কেন এই আইন প্রয়োগ করা সমীচীন নয়। যদি এই আইন সঠিকভাবে বিচারিক আদালতে প্রয়োগ করা হতো, তাহলে এই ধরনের মামলা আপিল বিভাগ পর্যন্ত আসত না। এ ধরনের মামলায় দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ প্রয়োগ না করা শুধু দুঃখজনকই নয়, প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।

নথিপত্র পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬২ শতাংশের বেশি লোক গ্রামাঞ্চলে বাস করেন। যেখানে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শহরের তুলনায় বেশি এবং তাঁদের মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদও বেশি হয়। এই মামলার ঘটনা শুরু হয়েছিল খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে।

আদালতে নূর মোহাম্মদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী জয়নুল আবেদিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নূর মোহাম্মদ জামিনে ছিলেন। আপিল বিভাগ তাঁর জরিমানা বহাল রেখেছেন।

নথিপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৮৬ সালের ১৫ জুলাই ওই মারপিটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় করা মামলায় ১৯৯৪ সালের ৩১ জানুয়ারি গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রায় দেন। রায়ে নূর মোহাম্মদকে দণ্ডবিধির ৩২৫ ধারায় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৩২৩ ধারায় অপরাধের জন্য দুই হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। অন্য আসামিদের দণ্ডবিধির ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য ২ হাজার ও ৫০০ টাকা করে জরিমানা করেন। এর বিরুদ্ধে ওই বছরই আসামিরা গাজীপুরের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে (প্রথম আদালত) আপিল করেন। ২০০৫ সালের ৭ জুলাই আপিল খারিজ হয়, বিচারিক আদালতের রায় ও আদেশ বহাল থাকে।

এর বিরুদ্ধে আসামিরা ওই বছরই হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন। ২০১৭ সালের ২ মার্চ হাইকোর্ট রিভিশন আবেদন খারিজ করে দেন। এর বিরুদ্ধে আসামি নূর মোহাম্মদ বিলম্ব ক্ষমা চেয়ে লিভ টু আপিল করেন। ২৫৯ দিনের বিলম্ব মার্জনা করে লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে রায় দেওয়া হয়।

আইন ও পরিপত্র
১৯৬০ সালের ১ নভেম্বর প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স হয়। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে আইনটির কার্যকর প্রয়োগ দেখা যায়নি। কারাগারের ওপর চাপ কমানো এবং ‘সংশোধনমূলক’ সাজার নীতি প্রয়োগে আইনটির বিধান প্রতিপালনে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিচারকদের প্রতি নির্দেশনাসংবলিত পরিপত্র জারি করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।