কালো ধোঁয়া, ধুলাবালুতে একাকার

গাজীপুর জেলার ম্যাপ

গাজীপুরে বাড়ছে শিল্পকারখানা। এসব শিল্পকারখানার ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ ছাড়া যত্রতত্র গড়ে ওঠা ইটভাটা ও নির্মাণকাজের ধুলাবালু বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। বায়ুমান সূচকেও উঠে এসেছে বিষয়টি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেস) প্রকল্পের আওতায় বায়ুর মান খতিয়ে দেখা হয়। এ জন্য ঢাকায় চারটি, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট মহানগর এবং গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে একটি করে নির্মল বায়ু পরীক্ষাকেন্দ্র চালু রয়েছে। ১১টি কেন্দ্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে বাতাসকে ভালো, মধ্যম, অস্বাস্থ্যকর, খুব অস্বাস্থ্যকর, অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর—এই মানে চিহ্নিত করা হয়।

কেস প্রকল্পের গাজীপুর কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত বুধবার গাজীপুরের বাতাস ছিল খুব অস্বাস্থ্যকর। এদিন বাতাসের মানসূচকে (একিউআই) জেলাটির স্কোর ছিল ২০৪। বায়ুমান নির্ধারণ করতে সারা বিশ্বে একিউআই সূচক ব্যবহার করা হয়। এই সূচক অনুযায়ী, স্কোর ০-৫০ ভালো, ৫১-১০০ মধ্যম, ১০১-১৫০ সতর্কাবস্থা, ১৫১-২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।
গাজীপুরে ধুলাদূষণের অন্যতম একটি কারণ বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ। গাজীপুরের টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার সড়কে তিন-চার বছর ধরে চলছে এ প্রকল্পের কাজ। ওই কাজের জন্য চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে ব্যাপক ধুলাবালুর সৃষ্টি হচ্ছে। ধুলাবালুর কারণে পথচারী ও স্থানীয় বাসিন্দারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেছেন, বিআরটি প্রকল্পের কাজের সময় সড়কে পানি ছিটানোর কথা থাকলেও পানি ছিটানো হচ্ছে না। যার কারণে ধুলাবালুতে একাকার হয়ে যাচ্ছে এলাকা।

ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী স্টেডিয়ামের সামনে, টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকা, বোর্ডবাজার এলাকায় মৎস্য ও বীজ উৎপাদন খামারের সামনে চলছে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি। আরেকটু সামনে কুনিয়া বড়বাড়ি থেকে মালেকের বাড়ি পর্যন্ত একই অবস্থা। গাজীপুরের বোর্ডবাজার থেকে চান্দনা চৌরাস্তার জাগ্রত চৌরঙ্গী ভাস্কর্য পর্যন্ত সড়কে ধুলাবালুতে দিনের বেলায় কুয়াশার মতো অবস্থা হয়ে থাকে।

চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার মুদিদোকানি আবদুল লতিফ গত মঙ্গলবার বলেন, ‘দোকানের সামনে আধা ঘণ্টা বসে থাকলে দেখবেন সড়কের কাজের ধুলাবালুতে আপনাকে আর চেনার উপায় থাকবে না। শুনেছি, কাজের সময় পানি দেওয়ার কথা কিন্তু পানি দিতে আর দেখা যায় না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটি প্রকল্পের প্রকৌশলী মোহাসিন উজ্জামান বলেছেন, ধুলা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিনই পানি ছিটানো হয়। কিন্তু প্রচণ্ড রোদের কারণে পানি খুব অল্প সময়েই শুকিয়ে যায়। এতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ধুলা হয়।
গাজীপুরে নির্মাণকাজের পাশপাশি বায়ুদূষণের জন্য দায়ী শিল্পকারখানার কালো ধোঁয়া। গাজীপুর শিল্প পুলিশ জানায়, গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় দেড় হাজার পোশাক কারখানাসহ ছোট–বড় প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিল্পকারখানা রয়েছে। গাজীপুরে দুই–তিনটি শিল্পকারখানাকে কর্তৃপক্ষ ‘গ্রিন কারখানা’ ঘোষণা করলেও বাকিগুলো সেই পথে এখনো হাঁটেনি। এতে এসব শিল্পকারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুমান নষ্ট করছে।

পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ নামের একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোক্তা ও গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন কলকারখানার নির্গত দূষিত বাতাস, বিভিন্ন রাস্তার চলমান উন্নয়নকাজ, যত্রতত্র ময়লার ভাগাড়, অসংখ্য ইটভাটা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। তবে কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এ দূষণ কমানো যেতে পারে।’

গাজীপুর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন এলাকায় গত বছর ১৭৪টি ইটভাটা ছিল। বেআইনিভাবে ইটভাটাগুলো চলায় গত বছর অভিযান চালিয়ে সেগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও সদরে ইটভাটা রয়ে গেছে, যেগুলোর বেশির ভাগই আবাসিক এলাকায়। আবার কিছু ইটভাটা করা হয়েছে ফসলি জমিতে। এসব এলাকার বাসিন্দাদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগও দেখা দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) গাজীপুর আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইটভাটার যে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা, অনেকেই তা করছেন না। এতে বায়ুদূষণ ঘটছে। তা ছাড়া কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি, ব্যাটারি তৈরির কারখানা ও স্টিল কারখানাও বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখছে।’
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আ. সালাম সরকার বলেন, সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভাসমান ক্ষতিকর বস্তুকণা এখনকার বাতাসে বিরাজ করছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব। এ ছাড়া সড়কে যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি ও অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ বন্ধের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি করলে ফল পাওয়া যাবে।

বায়ুদূষণের কারণে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি সম্পর্কে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক তপন কান্তি সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হাসপাতালে অ্যাজমা-অ্যালার্জি, ব্রঙ্কাইটিস, সাইনোসাইটিস, গলাব্যথাসহ নানা ধরনের শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এসব রোগের বড় কারণ বায়ুদূষণ।