কাহালুর হাতপাখা ব্যবসায় বৈশাখী হাওয়া
বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি, এমন দুর্গম গ্রামে কিংবা লোডশেডিংয়ের শহুরে জীবনে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয় তালপাতার তৈরি হাতপাখা। প্রযুক্তির উৎকর্ষে হয়তো হাতপাখার চাহিদা কমেছে। তবে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হাতপাখা। ঐতিহ্যবাহী এই হাতপাখার তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বগুড়ার কাহালু উপজেলার যোগীরভবন, আড়োলা, বাগোইল, আখরাইল গ্রামের প্রায় এক হাজার কারিগরের জীবন-জীবিকা।
প্রতিবছর ফাগুন থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত তালপাখার চাহিদা বেড়ে যায়। এর মধ্যে চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে মেলা মৌসুমে তালের পাখা তৈরির ধুম পড়ে। করোনার কারণে প্রায় দুই বছর পাখার ব্যবসায় মন্দা ছিল। তবে এ বছর বৈশাখ উপলক্ষে কারিগরদের ঘরে ঘরে আবার পাখা তৈরির ধুম পড়েছে। প্রায় দুই বছর পর হাতপাখার গ্রামগুলোতে প্রাণ ফিরেছে।
করোনার আগে একটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ত গড়ে আট টাকা। বিক্রি হতো ১০ থেকে ১২ টাকায়। তালপাতা ও বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ডাঁটা পাখা তৈরিতে প্রায় ১৪ টাকা খরচ পড়ছে। বিক্রি হচ্ছে গড়ে ২২ টাকায়।
বৈশাখ উৎসবকে ঘিরে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কারিগরেরা বাড়ির উঠানজুড়ে দল বেঁধে হাতপাখা তৈরি করছেন। নারী থেকে পুরুষ, কিশোর থেকে বৃদ্ধ—কারও দম ফেলানোর ফুসরত নেই। তালগাছ থেকে পাতা কেটে শুকাতে ও পাখা তৈরি করতে নির্ঘুম সময় পার করছেন কারিগরেরা।
সম্প্রতি সরেজমিনে কাহালু উপজেলার যোগীরভবন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘরে ঘরে কারিগরেরা তালপাখা তৈরির কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত। দুপুর ১২টায় কারিগর রেজাউল করিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, উঠানজুড়ে তালপাখার ডাঁটা। উঠানের একপাশে রং লাগানো কিছু পাখা রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। ছেলেকে নিয়ে রেজাউল করিম ব্যস্ত তল্লা বাঁশের চাক তৈরিতে। পাশে প্লাস্টিকের সুতায় চাক বাঁধছেন রেজাউলের স্ত্রী ও মেয়ে।
রেজাউল বলেন, ‘করোনার দুই বছর পাখার ব্যবসা ছিল না। গত বছর পয়লা বৈশাখের আগে অনেক পাখা মজুত করেছিলাম। কিন্তু পাখা কেনার লোক ছিল না। ১৪ টাকার পাখা ৮ থেকে ১০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। তবে এবার বেচাকেনা ভালো হচ্ছে।’
গত বছরের ১০ টাকা দামের ডাঁটা পাখা এবার ২২ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি করছেন রেজাউল। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বগুড়ার আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিনই পাখার অর্ডার আসছে। অনেক পাইকারি ব্যবসায়ী বাড়িতে এসেও দরদাম করে পাখা কিনছেন। এ কথা বলতে না বলতেই গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে দুই পাইকারি ব্যবসায়ী রেজাউলের বাড়িতে পাখা কিনতে এলেন।
পাখা কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পাখা তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার পাখার দামও বেড়েছে। কারিগরেরা জানান, নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলা থেকে তালপাখার ডাঁটা আসে। করোনার আগে ৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে প্রতিটি ডাঁটা মিলত। এখন ডাঁটার দাম বেড়ে হয়েছে সাত টাকা। তালপাখায় ব্যবহৃত রঙের দাম প্রতি কেজিতে ১০০ টাকা বেড়েছে। পাখা তৈরিতে ব্যবহৃত তল্লা বাঁশের দামও বেড়েছে। ৬০ টাকার বাঁশ এখন হয়েছে ১০০ টাকা। এ ছাড়া প্লাস্টিকের সুতা, কাঠি দিয়ে ‘খিড়িল’ বাঁধা ও নকশায় খরচ বেড়েছে।
‘কারিন্টের পাংখার ভিড়ে হাতপাখা হারিয়ে যাচ্ছে। এতে এই পেশা টিকবি কি না, তা লিয়ে শঙ্কাত আচি।’
যোগীরভবন গ্রামের প্রবীণ কারিগর আবদুল লতিফ (৬০) বলেন, স্বাধীনতার পর একটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ত আট আনা। বিক্রি হতো এক থেকে দেড় টাকায়। ধীরে ধীরে সব জিনিসের দাম বেড়েছে। করোনার আগে একটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ত গড়ে আট টাকা। বিক্রি হতো ১০ থেকে ১২ টাকায়। তালপাতা ও বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ডাঁটা পাখা তৈরিতে প্রায় ১৪ টাকা খরচ পড়ছে। বিক্রি হচ্ছে গড়ে ২২ টাকায়।
যোগীরভবন গ্রামের প্রবীণ কারিগর আমজাদ হোসেন (৬০) বলেন, সাত প্রজন্ম ধরে তাঁরা হাতপাখা তৈরি করছেন। বংশপরম্পরায় তিনিও এ পেশায় জড়িয়েছেন। তবে বৈদ্যুতিক ফ্যান ও প্লাস্টিকের হাতপাখার প্রচলনের কারণে তালপাখার কদর আগের চেয়ে কমেছে। অনেকেই এখন পেশা পাল্টে কৃষিকাজে ঝুঁকেছেন।
আড়োলা গ্রামের কারিগর মেরিনা বেগম বলেন, ‘কারিন্টের পাংখার ভিড়ে হাতপাখা হারিয়ে যাচ্ছে। এতে এই পেশা টিকবি কি না, তা লিয়ে শঙ্কাত আচি।’
তালপাখার কদর দেশজুড়ে
যোগীরভবনের প্রবীণ কারিগর হুজুর আলী বলেন, যোগীরভবন গ্রামে শত বছরের পুরোনো মন্দির আছে। আগে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা এ মন্দিরে পূজা-অর্চনা করতে আসতেন। মন্দিরে আসা ভক্তদের সেবায় তখন গ্রামের হিন্দু কারিগরেরা হাতপাখা তৈরি শুরু করেন। পরে আশপাশের গ্রামেও তালপাখা তৈরি শুরু হয়।
কাহালুর তালপাখার কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার হাতপাখার বাজার রাজধানী ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহসহ দেশজুড়ে। রমনার বটমূলের বৈশাখী মেলা, চট্টগ্রামের লালদীঘি জব্বারের মেলা, দোহারের নুরুল্যাপুর স্যানাল ফকিরের মেলা, ধামরাইয়ের রথের মেলা, কুষ্টিয়ার লালন মেলা, যশোরের মধুমেলা, ফরিদপুর পল্লিকবি জসীমউদ্দীন মেলা, বগুড়ার পোড়াদহ, কেল্লাপশী, গাংনগর, দাড়িয়াল মেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বৈশাখী মেলায় পাওয়া যায় কাহালুর কারিগরদের হাতপাখা।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে যোগীরভবন গ্রামে হাতপাখা কিনতে আসা ব্যবসায়ী ফিরোজ আলম বলেন, কাহালুর হাতপাখার মান ভালো ও টেকসই। তাই ক্রেতাদের কাছে এখানকার পাখার কদরও বেশি।
যোগীরভবন গ্রামে পাখা কিনতে আসা ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার পাখার চাহিদা বেড়েছে। কারিগরদের বাড়ি বাড়ি ঘুরেও পাখা মিলছে না। দামও বেড়ে গেছে। তবে দাম বেশি হলেও এখানকার পাখাই ক্রেতারা পছন্দ করেন।