‘কিচ্ছু চাই না, আমরা বাঁচার লাইগ্যা আশ্রয়কেন্দ্র চাই’

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধুলাসার ইউনিয়নের কাউয়ার চর এলাকায় এসব ঘরে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন দরিদ্র মানুষজন।
প্রথম আলো

‘সিডরে আমাগো সবকিছু ভাসাইয়া লইয়া গ্যাছে। এই চরেই আবার মাথা গোঁজবার ঠাঁই বানাইছি। আমরা কিচ্ছু চাই না, আমরা বাঁচার লাইগ্যা আশ্রয়কেন্দ্র চাই।’ এই দাবি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কাউয়ার চরের বাসিন্দা গোলবানু বেগমের। পাশের গ্রাম চর গঙ্গামতির জেলেপল্লির আবদুর রশিদ বললেন, ‘আমরা আশ্রয়কেন্দ্রের লাইগ্যা মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছে বহু দেনদরবার করছি। মোগো তো যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। পানিতে ভাসলে আর ঝড়ে উড়াইয়া নেলেও এইহানেই মোগো থাকতে অইবে।’

স্থানীয় মানুষজন জানান, বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ দুটি চরে ১০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করেন। এখানে অবস্থাপন্ন গৃহস্থ পরিবারের সংখ্যা কম। খড়কুটার ছোট ছোট খুপরিঘর তুলে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা বেশি। এসব মানুষের কেউ চিংড়ির পোনা ধরে, আবার কেউ জেলে বা জেলেদের ট্রলার কিংবা নৌকায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। যখনই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়, তখনই এখানকার বাসিন্দারা সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৩ বছর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল চর দুটি। প্রাণহানিও ঘটে। তবে চর গঙ্গামতি ও কাউয়ার চরে এখন পর্যন্ত কোনো আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। ফলে এই এলাকার মানুষজন বরাবরের মতো দুর্যোগের ঝুঁকিতেই রয়ে গেছেন।

২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় এই উপজেলায় ১০৪ জন মানুষ মারা যায়। তাদের মধ্যে এ দুটি চরেই ৯ জন মারা যায়।

ধুলাসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল জলিল আকন জানান, সিডরের রাতে কাউয়ার চরের বাসিন্দা মনির সিকদার তাঁর সাত মাস বয়সের সন্তান বায়েজিদকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন। সে সময় তাঁর কোল থেকে বায়েজিদ পড়ে যায়। পরদিন বায়েজিদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া সিডরের তাণ্ডবে কাউয়ার চর গ্রামের কাওসার দফাদারের মা জাহানারা বেগম ও তাঁর পুত্রবধূ ফাতেমা বেগম মারা যান। পাশের চর গঙ্গামতি গ্রামেও ছয়জন মারা যায়। সহায়–সম্বলহীন হয় কাউয়ার চরের অন্তত ৭০০ এবং চর গঙ্গামতির ৩৫০ পরিবার। গ্রামের মানুষের ৪০০ গরু-ছাগল, ২ হাজারের মতো হাঁস-মুরগি মারা যায়। এর কারণ হলো, গ্রাম দুটির বেশির ভাগ মানুষ বাঁধের বাইরে বসবাস করে। সাগরের স্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাস হলেও মুহূর্তের মধ্যে এখানকার মানুষের সব ভেসে যায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গঙ্গামতি ও কাউয়ার চরের বাসিন্দাদের যাতায়াতের মেঠো পথ মাটি দিয়ে উঁচু করা হয়েছে। এখনো খুপরিঘরেই অধিকাংশ মানুষ বসবাস করছে। তবে কেউ কেউ তুলতে শুরু করেছে টিনের ঘর। পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টে গেলেও দুর্যোগকালে এ চরের বাসিন্দাদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়নি।

‘মোরা অ্যাহন রৌদে পুড়ি, আর বৃষ্টিতে ভিজি। এইরহম কইর‌্যা দিন পার করি। মোরা সামনেও যেন ভালো থাকতে পারি, হেই ব্যবস্থাডা চাই।’
রাবেয়া বেগম, স্থানীয় বাসিন্দা

ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর উপজেলা প্রশাসন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা একশনএইডের সহায়তায় সরকারি খাসজমির ওপর এখানকার ২৭টি পরিবারকে পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে কাউয়ার চরে ৯টি এবং বাঁধের ভেতরে চর চাপলী গ্রামে ১৮টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এসব বাড়িতে ৬টি পিলারের ওপর ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেলেও যাতে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হয়, সে জন্য ঘরের নিচের অংশ পুরোপুরি ফাঁকা রাখা হয়েছে। টং আদলে তৈরি করা ঘরগুলো বাইরে থেকে দেখতে ভালো মনে হলেও এসব ঘরের ছাদ-দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ফলে বর্ষার সময় ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। দেয়াল ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। ওপরে ওঠার সিঁড়ির দু-পাশের লোহার হাতল, জানালার গ্রিল মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। কোনো কোনো ঘরের সিঁড়ির লোহার হাতলও নেই।

মহিউদ্দিন মুন্সী নামের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘নতুন থাকতে এই ঘরে আমরা শান্তিতেই বাস করছি। অ্যাহন আর হেই শান্তি নাই। যহন একটু জোড়ে ধাবার (ঝড়) ছাড়ে, তহন পাকা ঘরগুলান দোলনার মতন দোলে। হয়তো কথাডা আমনেগো কাছে বিশ্বাস হইবে না। কিন্তু যা কইছি হেইডাই সত্য।’ রাবেয়া বেগম নামে এখানকার আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘মোরা অ্যাহন রৌদে পুড়ি, আর বৃষ্টিতে ভিজি। এইরহম কইর‌্যা দিন পার করি। মোরা সামনেও যেন ভালো থাকতে পারি, হেই ব্যবস্থাডা চাই।’

চর গঙ্গামতি এবং কাউয়ার চরের মানুষের দুর্যোগকালীন নিরাপত্তায় মাটির তৈরি মুজিব কিল্লা করার জন্য ৫ একর জায়গা চিহ্নিত করা রয়েছে। সেখানে কিল্লা করার জন্য একটি প্রস্তাব ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
মো. আছাদউজ্জামান খান, সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি

কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় এই উপজেলায় ১০৪ জন মানুষ মারা যায়। তাদের মধ্যে এ দুটি চরেই ৯ জন মারা যায়। তবে যারা মারা গেছে, তাদের অধিকাংশই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে বসবাস করত। আবহাওয়ার বিপৎসংকেত পেয়ে অধিক দূরত্বে অবস্থিত আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় বানের স্রোতে পড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) সহকারী পরিচালক মো. আছাদউজ্জামান খান বলেন, চর গঙ্গামতি এবং কাউয়ার চরের মানুষের দুর্যোগকালীন নিরাপত্তায় মাটির তৈরি মুজিব কিল্লা করার জন্য ৫ একর জায়গা চিহ্নিত করা রয়েছে। সেখানে কিল্লা করার জন্য একটি প্রস্তাব ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য মাটির তৈরি মুজিব কিল্লা গ্রামীণ জনপদে নির্মাণ করা গেলে দুর্যোগের সময় মৃত্যুঝুঁকি কমে আসবে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান এ কে এম আবদুল আহাদ বিশ্বাস বলেন, একটি এলাকায় মোট জনসংখ্যার হিসাবে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। সে জন্য পরিপূর্ণ পরিকল্পনা থাকতে হবে। অসচ্ছল যাঁরা, তাঁদের কথা গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করে আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। হয়তো দুর্যোগপূর্ণ এলাকার যাঁরা এ নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরা সঠিকভাবে কোনো কোনো এলাকার চিত্র উচ্চপর্যায়ে তুলে ধরেননি। যার কারণে এখনো অনেক মানুষ দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়ে গেছে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাগরের কোলঘেঁষা ওই দুটি গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য নতুন একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির জন্য প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তবে আশার কথা হলো, ওই দুটি গ্রামের যাঁরা গৃহহীন ও ভূমিহীন, তাঁদের ৪০টি পরিবারকে নিরাপদ ও উঁচু স্থানে দুর্যোগ–সহনীয় ঘর তুলে দেওয়ার উদ্যাগ নেওয়া হয়েছে। অতিদ্রুত এ কাজ শুরু হবে। এতে করে ৪০টি পরিবারের প্রায় ২৫০ জনের পুনর্বাসন হবে।