কিশোর জুয়েলের জীবনযুদ্ধ

বাড়ি ঝিনাইদহ সদরের পারিয়াট গ্রামে। বাবা মারা গেছেন। পড়ালেখা করার পাশাপাশি তালপাতার পাখা বিক্রি ও ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায় সে।

কিশোর জুয়েল রানা হাতপাখা তৈরির কাজ করছে। সম্প্রতি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের পারিয়াট গ্রামে জুয়েলের বাড়িতে
ছবি: প্রথম আলো

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের নিমতলা বাসস্ট্যান্ডে এক কিশোর বেশ কিছু তালপাতার পাখা বোঝাই করছে পিকআপ ভ্যানে। ভ্যানগাড়ি থেকে দুই হাজার তালপাতার পাখা মাথায় নিয়ে পিকআপ ভ্যানে তুলে দিল। এরপর ভ্যানটি চালিয়ে যখন ফিরে যাচ্ছিল, ঘেমে–নেয়ে একেবারে পরিশ্রান্ত।

তালপাতার পাখা কোথা থেকে নিয়ে এসেছ—প্রশ্নটি করতেই মায়াভরা চেহারার ওই কিশোরের সোজা উত্তর, ‘এগুলো আমার তৈরি। অবসর সময়ে আমি নিজেই এই পাখা তৈরি করি। এতে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে পড়ালেখা করি। আর ভ্যানটি চালিয়ে সংসার চালাই।’

এই কিশোরের কাঁধে সংসার চালানোর ভারী বোঝা কীভাবে এসে পড়ল, তা জানার কৌতূহল হলো। কথায় কথায় জানা গেল, ওই কিশোরের নাম জুয়েল রানা। বয়স ১৭ পেরিয়েছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া আমেনা খাতুন ডিগ্রি কলেজ থেকে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। বাড়ি পারিয়াট গ্রামে। গ্রামটিকে অনেকে ‘পাখাপল্লি’ হিসেবে চেনেন। জুয়েলের বাবা নেই, বাড়িতে মা আর তিন ভাই। পাখা তৈরি দেখতে চাইলে হাসিমুখে আমন্ত্রণ জানিয়ে জুয়েল বলে, ‘কাল একটু কলেজে যেতে চেয়েছিলাম। সমস্যা নেই, আপনি এলে যাব না। এখন তো কলেজ বন্ধ।’

হতদরিদ্র ছেলেটি বাড়িতে হাতপাখা তৈরির পাশাপাশি বাবা মিন্টু সরদারের রেখে যাওয়া ভ্যান নিয়ে প্রতিদিন বাইরে বের হয়। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ টাকা আয় করে, যা দিয়ে তাদের চারজনের সংসার চলে। তালপাখা বিক্রির টাকায় পড়ালেখার খরচ জোটে, কিছু জমিয়ে রাখে ভবিষ্যতের প্রয়োজনে।

তালপাখা তৈরির গল্প জানতে চাইলে জুয়েল বলে, তাদের গ্রাম পারিয়াটে কমপক্ষে ২০টি পরিবার এই পাখা তৈরির কাজ করে। তার বাবাও ভ্যান চালানোর পাশাপাশি মৌসুমে পাখা তৈরি করতেন। অভাবের সংসার হওয়ায় শৈশবে পড়ালেখার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে বাবার কাজে সহযোগিতা করতে হতো। এখান থেকেই পাখা তৈরির কাজ শিখেছে সে। কিন্তু কখনো ভাবেনি, এই অল্প বয়সে পড়ালেখার সঙ্গে এই কঠিন কাজ করে তাকে সংসারের হাল ধরতে হবে। জুয়েল জানায়, ২০১৯ সালের ১৫ জুন বাড়িতে পরিচর্যা করার সময় একটি গরু তাঁর বাবা মিন্টু সরদারকে শিং দিয়ে সজোরে ধাক্কা দেয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। এরপর থেকে পরিবারের সব দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে।

জুয়েল বলে, বাবার মৃত্যুর পর সংসারের ভার কাঁধে নিয়েই এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে সে। মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ–৩ দশমিক ৮৭ পেয়েছে। আশা করছে, এইচএসসি পরীক্ষাতেও সে ভালোভাবে পাস করবে।

জুয়েলের বড় ভাই রানা ইসলাম (২১) শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ভ্যান চালান। এতে যা পান, তাতে নিজেরই দৈনন্দিন চাহিদা মেটে না। আর ছোট ভাই আরাফাত সরদার (১২) পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে।

মা শেফালি বেগম আশা করছেন, জুয়েল পড়ালেখা শিখে একটা চাকরি পেলে কষ্ট দূর হবে। কিন্তু ভয়, সংসার চালাতে এত কাজ যার কাঁধে, সে পড়ালেখায় ভালো করতে পারবে তো?