কিশোরগঞ্জের চ্যাপা যাচ্ছে বিদেশে

কিশোরগঞ্জে চ্যাপা গরিবের খাবার হিসেবে পরিচিত ছিল। দামও ছিল কম। কিন্তু এখন চ্যাপার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এটি উচ্চবিত্তদের মুখরোচক খাবার হয়ে উঠেছে
ছবি: প্রথম আলো

বাঙালির রসনাবিলাসে শুঁটকির জুড়ি নেই। আর তা যদি হয় চ্যাপা শুঁটকি, তাহলে তো কথাই নেই। দেশি জাতের শুঁটকি সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় হাওরাঞ্চলে। পাশাপাশি চ্যাপার উৎপাদনও এই অঞ্চলেই বেশি। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলেদের বড় একটি অংশ সনাতন পদ্ধতিতে মাছ প্রক্রিয়াকরণ করে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এসব শুঁটকি দিয়েই চ্যাপা নামের বিশেষ মৎস্যপণ্য উৎপাদন করা হয়।

চ্যাপা শুঁটকি এমনই একটি নাম, যা শুনলেই বাঙালির জিবে জল এসে যায়। কিশোরগঞ্জ তথা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে চ্যাপা অতি প্রিয় এক খাবারের নাম। চ্যাপা শুঁটকিকে এই অঞ্চলে অনেকে ‘হিদল’ (সিদল) বলে। যদিও বলে রাখা ভালো, দেশের উত্তরাঞ্চলে সিদল বলতে যে বিখ্যাত খাবার পরিচিত, তা এটি নয়। সিদল তৈরি হয় ছোট দেশি মাছ কিংবা পুঁটির শুঁটকির সঙ্গে মানকচুর ডাঁটা মিশিয়ে গোল গোল মণ্ড করে। সেটি আর চ্যাপা ভিন্ন দুটি খাদ্য। যদিও দুটিই বাঙালির হারাতে বসা ঐতিহ্য।

শুধু কিশোরগঞ্জে নয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় এখন অতি প্রিয় মুখরোচক খাবার চ্যাপা। এই চ্যাপা এমনই এক উপাদেয় খাবার, যা মুখের রুচি বাড়িয়ে দেয়। কিশোরগঞ্জের চ্যাপার কদর আছে লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের বাঙালি–অধ্যুষিত এলাকায়। চ্যাপা নানাভাবে খাওয়া হয়। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্ভবত চ্যাপাভর্তা। শুকনা মরিচ বা কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, রসুনের সঙ্গে শিলপাটায় বা হাতে পিষে চ্যাপাভর্তা করা হয়। চ্যাপার ভুনাও খুব জনপ্রিয় খাবার।

চ্যাপা তৈরির মূল উপাদান পুঁটির শুঁটকি। নদী-খাল-বিল ও হাওর–অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর আশ্বিন-কার্তিক থেকে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে হাওরে প্রচুর পরিমাণ পুঁটি মাছ ধরা পড়ে। এসব পুঁটি মাছের নাড়িভুঁড়ি বের করে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। কিশোরগঞ্জ ছাড়াও আশপাশের হাওর–অধ্যুষিত জেলা থেকে শত শত মণ শুঁটকি আসে কিশোরগঞ্জ শহরের বড় বাজারের মোকামে।

চ্যাপা শুঁটকি এমনই একটি নাম, যা শুনলেই জিবে জল এসে যায়
ছবি: প্রথম আলো

সেখান থেকে চ্যাপা কারিগরেরা শুঁটকি কিনে নেন। এরপর মাটির বড় বড় মটকায় চেপে চেপে জাগ দিয়ে পাঁচ থেকে ছয় মাস রেখে দেন। চ্যাপা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ‘পুঁটি মাছের তেল’। পুঁটি মাছের পেট থেকে যে নাড়িভুঁড়ি বের করা হয়, তা জ্বাল দিলেই এ তেল পাওয়া যায়। মটকার মুখ মাটি দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়, যাতে ভেতরে কোনো অবস্থাতেই বাতাস ঢুকতে না পারে। চ্যাপা তৈরির ক্ষেত্রে এই বায়ুনিরোধক প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মটকার ভেতরে বাতাস ঢুকলে তাতে চ্যাপা হওয়ার পরিবর্তে মাছ পচে যাবে। চ্যাপা তৈরি হয়ে গেলে বিভিন্ন হাটবাজারে খুচরা বিক্রির পাশাপাশি স্থানীয় আড়তদারেরা সেগুলো কিনে গুদামজাত করেন। প্রক্রিয়াজাত করে এসব চ্যাপা দেশের বিভিন্ন স্থানসহ রপ্তানি হয় বিদেশে।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে কিশোরগঞ্জের চ্যাপার খ্যাতি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। অনেকে বিদেশ থেকে এলে ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যান চ্যাপা। এমনকি দেশের বাইরের স্বজনদের আবদারও পূর্ণ করতে হয় এই এলাকার মানুষকে। আবার অনেকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালি–অধ্যুষিত এলাকায় চ্যাপার ব্যবসা করে ভালো আয়ও করছেন। বর্তমানে কিশোরগঞ্জ ও হাওরবেষ্টিত অঞ্চলগুলো চ্যাপাশিল্পের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। একসময় কিশোরগঞ্জে চ্যাপা গরিবের খাবার হিসেবে পরিচিত ছিল। দামও ছিল কম। কিন্তু এখন চ্যাপার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এটি উচ্চবিত্তদের মুখরোচক খাবার হয়ে উঠেছে।

প্রতিটি মটকায় ৩০ থেকে ৪০ কেজি চ্যাপা ধরে। প্রকারভেদে এক মণ চ্যাপা ৫-৭ হাজার থেকে ৩৫-৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়
ছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের বড় বাজারের চ্যাপার ব্যবসায়ী মো. সেলিম ও তাপস চন্দ্র বর্মণ জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ বিদেশে যেসব এলাকায় বাংলাদেশিরা থাকেন, সেসব এলাকায় বিপুল পরিমাণ চ্যাপা তাঁরা বিক্রি করেন। তাঁরা বলেন, কিশোরগঞ্জেই বেশির ভাগ পুঁটি মাছের চ্যাপা তৈরি হয়। এ চ্যাপা তৈরিতে অনেকের হাত থাকে। প্রথমে জেলেরা নদী বা খাল-বিল থেকে মাছ ধরেন। তা মাচায় রেখে রোদে শুকানো হয়। পরে তা শুঁটকি ব্যবসায়ীরা ক্রয় করেন। যাঁরা চ্যাপা তৈরি করেন, তাঁরা শুঁটকি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুঁটির শুঁটকি কিনে তা থেকে ছোট, মাঝারি ও বড় আলাদা করে তা পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধোয়া হয়। এরপর সেগুলো ঠেসে ঠেসে মটকায় ভরতে হয়, যাতে ভেতরে কোনো ফাঁকা জায়গা না থাকে। মটকার শেষ ভাগে চ্যাপার গুঁড়া দিয়ে ভরে কাগজ দিয়ে ঢেকে এর ওপর মাটি দিয়ে মটকার মুখটিকে শক্ত করে পলিথিন দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর মটকাটি পাঁচ থেকে ছয় মাস পর খুলে চ্যাপা বের করা হয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিটি মটকায় ৩০ থেকে ৪০ কেজি চ্যাপা ধরে। প্রকারভেদে এক মণ চ্যাপা ৫-৭ হাজার থেকে ৩৫-৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। কেজি হিসাবে কিনলে পড়বে ২৫০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা। চ্যাপা কারিগর ও ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পুঁটি মাছ সংগ্রহ করা হয়। করোনার আগে তাঁরা ৫০০ থেকে ১ হাজার মণ চ্যাপা বিক্রি করতে পারতেন। তাঁরা ছাড়াও কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের বড় বাজার থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি চ্যাপা শুঁটকি বিক্রি হয়। খুচরা হিসাবে প্রতিদিন ১০–১৫ হাজার টাকা চ্যাপা বিক্রি করতে পারেন। তবে করোনার আগে প্রচুর বেচাকেনা হলেও করোনার কারণে এখন বিদেশে চ্যাপা না যাওয়া তাঁদের ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, কিশোরগঞ্জের চ্যাপা শুঁটকি থেকে দেশের অর্থনীতিতে একটি বিরাট অঙ্কের অর্থ আসে। এ জন্য এগুলো কীভাবে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায়, সে বিষয়ে তাঁরা একটি পরিকল্পনা করছেন।