কৃষ্ণের সেলুন-পাঠাগার

সেলুন–পাঠাগারে চুল কাটছেন কৃষ্ণ চন্দ্র শীল। সম্প্রতি নেত্রকোনার দুর্গাপুর পৌরসভার বিরিশিরি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

শাহরুখ, সালমান, আমির থেকে শাকিব খান—নানা তারকার বাহারি চুলের কাটের ছবি। কখনো সিনেমার পোস্টার। মফস্বলের সাধারণ সেলুনের ভেতরের দৃশ্য এমনই। কিন্তু নেত্রকোনার দুর্গাপুর পৌরসভার বিরিশিরি এলাকায় দেখা মিলল ভিন্নধারার একটি সেলুনের। এর ভেতরটা মণি–মুক্তায় ঠাসা—রয়েছে অন্তত ২০০ বই।

সেলুনটিতে যাঁরা চুল কাটতে আসেন, তাঁরা তো বটেই, অন্যরাও এখানে আসেন বইয়ের টানে। বই পড়েন ভেতরে বসে। অনেকে সেলুন থেকে ধারে বাড়িতেও নিয়ে যান বই।

স্থানীয় লোকজন ও পাঠকেরা দোকানটির নাম দিয়েছেন সেলুন-পাঠাগার। তাঁরা বলেন, সেলুনে বই রাখার পর এখন আর চুল কাটতে এসে দীর্ঘ অপেক্ষার বিরক্তিকর সময় কাটাতে হয় না। পুরোটা সময় চুপটি করে বইয়ে মজে চলে যায়।

বিরিশিরি এলাকার অম রাংসা বলেন, এখন বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে ইন্টারনেট ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে সময় কাটায়। সেলুনে পাঠাগার হওয়ায় এখানে অনেকই এসে বই পড়তে পারেন। এটা খুব ভালো উদ্যোগ।

পাঠাগার করার পর থেকে সেলুনে লোকজনের সমাগম বেড়ে গেছে। ভালো পরিবেশ হচ্ছে, আয়ও বেড়েছে। অনেকেই বই বাড়িতে নিয়ে যান। এতে আমি খুব আনন্দ পাই।
কৃষ্ণ চন্দ্র শীল, সেলুনের মালিক
কৃষ্ণের সেলুন–পাঠাগারে কেউ পড়ছেন বই, কেউ পড়ছেন পত্রিকা। সম্প্রতি নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বিরিশিরি এলাকায়।
ছবি: প্রথম আলো

সেলুনটির মালিক কৃষ্ণ চন্দ্র শীল (৩৮)। আর সেটিতে পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক দীপক সরকারের (৪০) উদ্যোগে। কৃষ্ণের বাড়ি পৌরসভার দক্ষিণ ভবানীপুর এলাকায়। আর দীপকের বাড়ি গাভিনা গ্রামে।

কৃষ্ণ শীল বলেন, ‘পাঠাগার করার পর থেকে সেলুনে লোকজনের সমাগম বেড়ে গেছে। ভালো পরিবেশ হচ্ছে, আয়ও বেড়েছে। করোনাকালেও অন্যান্য পাঠকের পাশাপাশি আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন বই পড়তে আসেন। অনেকেই বই বাড়িতে নিয়ে যান। একটি রেজিস্ট্রার খাতায় পাঠকেরা নিজ উদ্যোগেই এন্ট্রি করেন। এতে আমি খুব আনন্দ পাই।’

সেলুনে চুল কাটাতে এসে অনেক সময় মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়। এতে অনেকে বিরক্তি বোধ করেন। সে সময়টা পড়াশোনার কাজে ব্যবহারের সুযোগ করে দিতেই সেলুন-পাঠাগারের উদ্যোগ নেওয়া।
দীপক সরকার, সেলুনে পাঠাগারের উদ্যোক্তা

স্থানীয় বাসিন্দা ও সেলুনে আসা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কৃষ্ণ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর বংশগতভাবে নরসুন্দর পেশায় ঢুকে যান। কিন্তু স্কুলের পড়াশোনার পাট চুকলেও কৃষ্ণের পড়ার তৃষ্ণা মেটেনি। সময় পেলেই তিনি বিভিন্ন বই, ম্যাগাজিন ও পত্রিকা পড়তেন। ২০১২ সালে দীপক তাঁর গ্রামের বাড়িতে জলসিঁড়ি পাঠকেন্দ্র নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। সেখানে কৃষ্ণ সুযোগ পেলেই পড়তে যেতেন। কখনো কখনো তিনি পড়ার জন্য সেখান থেকে বই এনে সেলুনে রাখতেন। কাজের ফাঁকে পড়তেন। তাঁর পাশাপাশি সেলুনে আসা লোকজনও ওই বই হাতে নিয়ে পড়তেন। বিষয়টি নজরে আসে দীপকের।

গত বছরে মার্চে কৃষ্ণের সেলুনে একটি বইয়ের তাক স্থাপন করেন দীপক। সেখানে বিভিন্ন ধরনের ৬৫টি বই রাখেন। এরপর সেলুনে দিন দিন পাঠকের ভিড় বাড়তে থাকে। বর্তমানে সেলুনটিতে অন্তত ২০০ বই রাখা। এর মধ্যে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা, কবিতা, আত্মজীবনী, শব্দকোষ, ভ্রমণকাহিনি, লোকসংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বই রয়েছে। পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক ম্যাগাজিনও রয়েছে।

দীপক সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সেলুনে চুল কাটাতে এসে অনেক সময় মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়। এতে অনেকে বিরক্তি বোধ করেন। সে সময়টা পড়াশোনার কাজে ব্যবহারের সুযোগ করে দিতেই সেলুন-পাঠাগারের উদ্যোগ নেওয়া। ভবিষ্যতে বইকে পাঠকের আরও কাছাকাছি নিয়ে যেতে সেলুন ছাড়াও জনসমাগম ঘটে, এমন স্থানে এর শাখা স্থাপনের চিন্তা রয়েছে।

কৃষ্ণের সেলুন–পাঠাগারে তাকভর্তি বই থেকে পছন্দেরটি খুঁজছেন এক পাঠক। সম্প্রতি নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বিরিশিরি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সেলুনটির পেছনে বিরিশিরি পিসি নল মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়, বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশনসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অবসরে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও এখানে বই পড়তে আসেন।

কলেজশিক্ষার্থী রাজন সেন বলেন, ‘পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে অবসরে আড্ডা দিতাম। এই পাঠাগার হওয়ার পর এখানে এসে বই পড়ি। আমার দেখাদেখি বন্ধুরাও আসে। অনেক বই আছে এখানে। বই কিনে পড়া কিছুটা ব্যয়বহুল। কিন্তু এখান থেকে বই নিয়ে পড়া যায়, বসে পড়া যায়।’

সম্প্রতি এক দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, সেলুনের বেঞ্চ ও চেয়ারে বসে কয়েকজন বই পড়ছেন। কেউ বই নেড়েচেড়ে দেখছেন, কোন বই নেবেন, পছন্দ করছেন।

কানিয়াইল গ্রামের আবদুর রাজ্জাকও এসেছিলেন সেলুনে। তিনি বলেন, ‘আমার আসলে বই কিনে পড়ার সামর্থ্য নেই। তাই এখানে নিয়মিত এসে পড়ি। বাড়িতেও নিয়ে যাই। বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এমন স্থান বেছে নেওয়ায় আমরা আনন্দিত।’

দেশের যেসব স্থানে জনসমাগম ঘটে, সেখানে এমন পাঠাগার করলে বই পড়া সহজ হবে। বইয়ের প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়বে।
মানেশ সাহা, সংস্কৃতিকর্মী, দুর্গাপুর

কৃষ্ণের সেলুন-পাঠাগারে রাখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা, মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটুখানি বিজ্ঞান, যতীন সরকারের আমার যেটুকু সাধ্য, হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী ও কত নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী, কবি নির্মলেন্দু গুণের চাষাভুষার কাব্য, খালেকদাদ চৌধুরীর শতাব্দীর দুই দিগন্ত, আনিসুল হকের মা ও আলো-আঁধারের যাত্রী ইত্যাদি।

দুর্গাপুর পৌরসভার মোক্তারপাড়া এলাকার বাসিন্দা সংস্কৃতিকর্মী মানেশ সাহা বলেন, ‘প্রায় সব বয়সের লোকজন এখন ইন্টারনেটে আসক্ত। অনেকে বই পড়া ভুলে গেছি। এমন সময়ে এ ধরনের উদ্যোগ সমাজে ভালো প্রভাব ফেলছে। দেশের যেসব স্থানে জনসমাগম ঘটে, সেখানে এমন পাঠাগার করলে বই পড়া সহজ হবে। বইয়ের প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়বে।’