‘কোলের শিশু বাঁচাইতে পারছি, মেজটারে পারি নাই’
নৌকা যখন ডুবছিল, তখন আঁখি আক্তারের কোলে ১৩ মাসের শিশু মোবাশ্বিরা। সামান্য দূরেই ছিল শিশু তানভীর হোসাইন ও শাশুড়ি জামিলা খাতুন। একপর্যায়ে দুই শিশুকেই ধরে রেখেছিলেন আঁখি। কিন্তু নৌকাটি ডুবে যাওয়ার পর কোলের শিশুকে ধরে রাখতে পারলেও আঁখির হাত থেকে ছুটে যায় তানভীর। কোলের শিশুসহ বেঁচে যান আঁখি। মৃত্যু হয় তানভীর ও শাশুড়ি জামিলার। অথচ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের মৃত ব্যক্তি ও আর্থিক সহায়তার তালিকায় জামিলার নাম নেই।
ডুবে যাওয়ার সময় নৌকায় থাকা আঁখির স্বামী মুরাদ মিয়া, বড় ছেলে তামিম হাসান (১০), দেবরের ছেলে রিফাত হোসেন (১৪) ও রিফাতের ভাই পিয়াস হোসেন (১২) বেঁচে যায়। উদ্ধারের পরপরই স্বজনেরা জামিলা খাতুনের (৬৫) লাশ ঘটনাস্থল থেকে বাড়িতে নিয়ে যান। যে জন্য জেলা প্রশাসনের আর্থিক সহায়তার তালিকায় তাঁর নাম ওঠেনি। আর্থিক সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছেন আঁখি। বিষয়টি তদন্ত করছে জেলা প্রশাসন।
আঁখি আক্তার সদর উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের সাদেকপুর গ্রামের মুরাদ মিয়ার স্ত্রী। জেলা শহরের ভাদুঘরে আঁখির বাবার বাড়ি। মুরাদ পেশায় দরজি। নৌকাডুবিতে আহত হয়ে তিনি এখন জেলা শহরের যমুনা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসাধীন। এদিকে নৌকাডুবিতে নিহত প্রত্যেকের জন্য ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেন জেলা প্রশাসক।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ননদ সাদেকা বেগমের মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে ২৩ আগস্ট বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগরে স্বামী, শাশুড়ি, তিন সন্তান ও দুই ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে যান আঁখি। শুক্রবার সেখান থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। নৌকাডুবির পর আঁখি কোনোক্রমে কোলের শিশু মোবাশ্বিরাকে নিয়ে বেঁচে যান। এরপরই তিতাস নদের লইস্কা বিলে উদ্ধারকারী একটি নৌকায় স্বামী মুরাদ ও বড় ছেলে তামিমকে দেখতে পান। কিন্তু মেজ ছেলে তানভীরকে (৮) খুঁজে পাননি। একপর্যায়ে আঁখি মোবাশ্বিরা, বড় ছেলে তামিম ও স্বামী মুরাদকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে যান। অন্যদিকে উদ্ধারের পরপরই শাশুড়ি জামিলার লাশ বিজয়নগরের চম্পকনগরে নেওয়া হয়। রাতেই স্বজনেরা জামিলার লাশ সদর উপজেলার সাদেকপুরে নিয়ে যান। শনিবার জানাজা শেষে জামিলার লাশ দাফন করা হয়। জামিলার মৃত্যুর ঘটনায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম আবদুল হাই একটি প্রত্যয়নপত্র দেন। এরপর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমিনের কাছে আর্থিক সহায়তার আবেদন করেন আঁখি। তিনি আবেদনটি সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইফ-উল-আরেফীনের কাছে পাঠান।
কথা হলে আঁখি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর শাশুড়ির লাশ উদ্ধারের পরপরই স্বজনেরা বিজয়নগর নিয়ে গেছেন। এ জন্য সহায়তার লিস্টে তাঁর শাশুড়ির নাম উঠছে না। ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। কান্নারত অবস্থায় তিনি বলেন, ‘আমি নৌকার ভিতরে বসা আছিলাম। কোলে শিশু মোবাশ্বিরা আছিল। শাশুড়ি ও মেজ ছেলে আমার থেইক্যা একটু দূরে নৌকার ভিতরেই আছিল। আর বড় ছেলে নৌকার সামনে বাবার লগে আছিল। প্রথম ধাক্কার পর মনে অইছে বাঁইচা গেছি। দ্বিতীয় ধাক্কার পর নৌকা ডুবতে শুরু করছে। কোলে এক হাতে মোবাশ্বিরাকে, আরেক হাতে তানভীরের গেঞ্জি ধরে রাখছিলাম। নৌকা থেকে বাইর হওয়ার চেষ্টা করতাছিলাম। নৌকাটি নিচের দিকে যাওয়া শুরু করলে হাত থেকে তানভীর ছুটে যায়।’
আঁখি আক্তার বলেন, ‘আমি সাঁতার জানি না। কোলের শিশু মোবাশ্বিরা ও আমি পানি খাইতে খাইতে কেমনে যে উপরে উঠছি, কইতাম পারি না। পানি খাইতাছে দেইখ্যা একজন আইয়্যা বাচ্চাডারে উদ্ধার করছে। এরপর কোনোমতে আমি তীরে গেছি। কিছুক্ষণ পর আরেকটা নৌকার মধ্যে স্বামী ও বড় ছেলেডারে দেখছি। স্বামীর কান দিয়া রক্ত পড়তাছিল। কাছে যাওয়ার পর স্বামী দ্রুত তাকে হাসপাতালে লইয়া যাইতে কইছে।’ তিনি বলেন, ‘কোলের শিশুকে বাঁচাইতে পারছি, মেজটারে পারি নাই।’
সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইফ-উল-আরেফীন বলেন, ‘নৌকাডুবিতে জামিলার মৃত্যুর বিষয়টি আমরা যাচাই করে দেখছি। সত্যতা পেলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। নৌকাডুবিতে আঁখির এক ছেলে তানভীরের মৃত্যু হয়েছে। আঁখিকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।’