খননের নামে বালু ‘লুট’

খননের মাটি আগাম নিলামে কিনে নেওয়া ব্যক্তিরাই অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয়ভাবে বানানো খননযন্ত্র দিয়ে গাজীখালী নদী খনন করে বালু বিক্রি করা হচ্ছে। গত বুধবার ধামরাইয়ের কাইউমতারা এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে প্রবাহিত গাজীখালী নদী পুনঃখননের কাজ চলছে। ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী খননে খরচ হচ্ছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ টাকা বরাদ্দ থাকার পরও খননের নামে খননযন্ত্র দিয়ে নদী থেকে বালু তুলে বিক্রি করা হচ্ছে। অথচ এক্সকাভেটর দিয়ে এই নদী খনন করার কথা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নদীর একটি অংশ খননের কাজ পাওয়া ঠিকাদার কোনো কাজই করছেন না। খননের মাটি আগাম নিলামে কিনে নেওয়া ব্যক্তিরাই শ্রমিক নিয়োগ করে স্থানীয় যন্ত্রের মাধ্যমে বালু তুলে বিক্রি করছেন।

মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, সদর, সিঙ্গাইরসহ ঢাকার ধামরাইয়ের সীমানা ঘেঁষে প্রবহমান ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ গাজীখালী নদী খননের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া গত বছর শেষ হয়। সাটুরিয়ার গোপালপুর থেকে ১৫ কিলোমিটার অংশের কাজ পায় কেএসএ ও টিটিএসএল নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। এরপর ১৫ কিলোমিটার থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত অংশে কাজ পেয়েছে টিটিএসএল ও এসআর নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ৩০ কিলোমিটার থেকে ৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত অংশের কাজ পেয়েছে মেসার্স জামিল ইকবাল নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই অংশে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৭০৩ টাকা। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ২ মিটার গভীর করে তলদেশে ২৬ মিটার এবং ওপরে স্থানভেদে ৫০ থেকে ৬০ মিটার প্রশস্ত করে নদী খনন করা হবে এবং খননকাজে এক্সকাভেটর ব্যবহার করতে হবে।

গত বুধবার ধামরাইয়ের বারবারিয়া থেকে আটিমাইটাইল পর্যন্ত নদীর প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে কোনো এক্সকাভেটর পাওয়া যায়নি। এ সময় নদীর ওই অংশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয়ভাবে বানানো অন্তত ১০টি খননযন্ত্রের সাহায্যে বালু উত্তোলন করতে দেখা যায়। উত্তোলন করা বালু পাইপের সাহায্যে নদীর তীর থেকে কিছু দূরে স্থানে স্থানে স্তূপ করা হচ্ছিল। সেখানে থেকে বালু বিক্রির পর তা ট্রাকে করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

ধামরাইয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামিউল হক বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টিটিএসএল ও এসআরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো প্রকল্পে নদী খননের মাধ্যমে উত্তোলন করা বালু বা মাটি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। আগাম নিলামে অংশ নিয়ে ধামরাইয়ের কালামপুরের জনৈক সাইফুল ইসলাম ও রাজধানীর শেওড়াপাড়ার শাহরিয়ার আহমেদ নামের দুই ব্যক্তি ২৫ লাখ ৩২ হাজার টাকায় ২ লাখ ৩৪ হাজার ৮৫৭ ঘনমিটার মাটি বা বালু কিনে নেন। নিলামের শর্ত অনুযায়ী তাঁরা প্রকল্প এলাকার ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার এবং ৩৭ থেকে ৪৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার অংশের খনন করে উত্তোলিত বালু বা মাটি নিতে পারবেন। কোনো অবস্থাতেই তাঁরা নদী থেকে বালু তুলে তা বিক্রি করতে পারবেন না।

খননের মাধ্যমে উত্তোলন করা বালু বা মাটি নিলামকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শর্ত অনুযায়ী আমাদের খনন করা মাটি বা বালু নেওয়ার কথা। কিন্তু ঠিকাদারের সঙ্গে সম্পর্ক করে আমরা সরাসরি নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছি।’

অভিযোগ অস্বীকার করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জামিল ইকবালের অংশীদার জগলুল ফারুক বলেন, তাঁরা এক্সকাভেটর দিয়ে নদী খনন করছেন। নিলামে মাটি ক্রয়কারীদের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই।

উত্তর কাইউমতারা গ্রামের তুলু মিয়া বলেন, তাঁর বাড়ির পাশে ৫০০ গজের মধ্যে তিন মাস ধরে চার থেকে পাঁচটি খননযন্ত্রের সাহায্যে নদী থেকে বালু তুলে করে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে একই জায়গায় বেশি গভীর হচ্ছে এবং নদীর তীরে ভাঙন ধরেছে।

ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলনের মানিকগঞ্জ জেলা কমিটির আহ্বায়ক আজাহারুল ইসলাম বলেন, নিলামে নদীর খনন করা বালু বা মাটি কেনার নামে নদী থেকে বালু লুট করা হচ্ছে। যত্রতত্র খননযন্ত্র বসিয়ে বালু তোলার ফলে সরকারের নদী খননের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী সালামত ফকির বলেন, এক্সকাভেটরের সাহায্যে নদী খনন করার কথা। কিন্তু পানির কারণে কোনো কোনো স্থানে এক্সকাভেটর ব্যবহার করা সম্ভব না হওয়ায় স্থানীয়ভাবে বানানো খননযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। নদী খননের বালু বা মাটি নিলামে নিয়ে সরাসরি নদী থেকে তোলার সম্পর্কে তিনি বলেন, নদী খননের কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার তাঁদের (নিলামকারী) সঙ্গে আঁতাত করে এটা করতে পারেন। অনিয়ম হয়ে থাকলে খতিয়ে দেখা হবে।