খরচ বেশি, বাজারে দর কম, লোকসানে চাষি

এবার পেঁয়াজের আবাদে কৃষকের খরচ হয়েছে অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। তা সত্ত্বেও পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়ায় রেকর্ড পরিমাণ জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত পেঁয়াজ হাটে এনে উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না কৃষকেরা। কৃষকদের দাবি, এবার প্রতি কেজি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ হয়েছে ২৫ থেকে ২৮ টাকা। অথচ বাজারে তাঁদের ১৮ থেকে ২৩ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে।

পেঁয়াজের ভান্ডার বলে পরিচিত সাঁথিয়া দেশের অন্যতম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী উপজেলা। তবে এ ক্ষেত্রে বেড়া উপজেলাও রয়েছে সামনের সারিতে। কৃষক ও কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর সাঁথিয়া উপজেলায় ১৬ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছিল। অথচ এবার আবাদ হয়েছে হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে। অন্যদিকে বেড়া উপজেলায় গতবার ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হলেও এবার হয়েছে ৫ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে।

চাষিরা জানান, গত দুই বছরে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এমন চড়া দাম দেখে কৃষকদের মধ্যে এবার পেঁয়াজ আবাদের হিড়িক পড়ে যায়। ফলে এবার পেঁয়াজের বীজ বিক্রি হয়েছে ব্যাপক চড়া দামে। কৃষকেরা জানান, গত বছর পেঁয়াজের বীজ প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার কৃষকদের ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা কেজি দরে তা কিনতে হয়েছে। আগাম পদ্ধতিতে (মূলকাটা) লাগানোর জন্য কৃষকদের এবার ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে অঙ্কুরিত পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে। অথচ গতবার এর দাম ছিল প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা।

এ ছাড়া এবার কীটনাশক, সেচ ও শ্রমিকের মজুরিও ব্যাপক বেড়েছে। ফলে কৃষকদের পেঁয়াজের আবাদে এবার অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। কৃষকেরা জানান, এবার কেজিতে উৎপাদন খরচ পড়েছে ২৫ থেকে ২৮ টাকা। যাঁরা অন্যের জমি বর্গা বা ভাড়া নিয়ে চাষ করে থাকেন, তাঁদের খরচ পড়েছে এর চেয়ে আরও বেশি।

পেঁয়াজচাষিরা জানান, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় পেঁয়াজের আবাদ হয়ে থাকে দুই পদ্ধতিতে। এর একটি হলো আগাম বা মূলকাটা ও অপরটি হলো হালি পদ্ধতি। মূলকাটা পদ্ধতিতে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পেঁয়াজের খেত তৈরি শুরু করে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে পেঁয়াজ ঘরে তোলা হয়। এ পদ্ধতিতে অঙ্কুরিত পেঁয়াজ জমিতে রোপণ করা হয়। মূলকাটা পেঁয়াজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না।

অন্যদিকে হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে খেত তৈরি শুরু করে মার্চ-এপ্রিলে ঘরে তোলা হয়। এ পদ্ধতিতে পেঁয়াজের বীজ থেকে চারা উৎপাদনের পর সেই চারা জমিতে রোপণ করতে হয়। হালি পেঁয়াজ দীর্ঘদিন ঘরে সংরক্ষণ করা যায়।

দেড় মাসের বেশি সময় ধরে আগাম বা মূলকাটা জাতের পেঁয়াজ বাজারে উঠছে। কৃষকেরা এবার পেঁয়াজ উৎপাদন করে ভালো লাভ পাবেন বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু নতুন পেঁয়াজ ওঠার পর থেকে দাম কমতে কমতে তা কৃষকের উৎপাদনের খরচের নিচে চলে গেছে। বাজারে এখন প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাইকারি ১৮ থেকে ২৩ টাকা টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে পেঁয়াজচাষিদের কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে।

গত শনিবার সরেজমিনে বেড়া পৌর এলাকার করমজা চতুরহাট ও সাঁথিয়ার বোয়াইলমারীহাটে প্রচুর নতুন পেঁয়াজের আমদানি দেখা গেছে। সাঁথিয়ার বোয়াইলমারীহাটে পেঁয়াজ নিয়ে আসা ঘুঘুদহ গ্রামের চাষি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অন্যবারের চাইতে এবার পেঁয়াজের আবাদে আমাগরে খরচ ম্যালা বেশি হইছে। আশা করিছিল্যাম ভালো লাভ করার। কিন্তু এখন লাভ দূরের কথা, খরচই তুলব্যার পারত্যাছি না।’

বেড়ার ঢালারচর ইউনিয়নের কোমরপুর গ্রামে দেখা যায়, মোমিন মণ্ডল নামের এক কৃষক তাঁর পরিবারের লোকজন নিয়ে জমি থেকে পেঁয়াজ তুলছিলেন। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘একসময় লোকসান খায়া পেঁয়াজের আবাদ বাদ দিছিল্যাম। লাভের আশায় এবার আবারও পেঁয়াজের আবাদ করিছি। কিন্তু আমাগরে কপালে পেঁয়াজের লাভ নাই।’

সাঁথিয়া বোয়াইলমারীহাটের আড়তদার মো. রাজা বলেন, ‘আজকে আমাগরে হাটে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বেচাকেনা হলো। এই দরে পেঁয়াজ বেইচ্যা কৃষকের ব্যাপক লোকসান হতেছে। সামনের মাসের থ্যা হালি পেঁয়াজ বাজারে উঠবি। এই পেঁয়াজে কৃষকের খরচ আরও বেশি। তাই এ রকম দাম থাকলি কৃষকের সর্বনাশ।’

সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা যথাক্রমে সঞ্জীব কুমার গোস্বামী ও মশকর আলী। তাঁরা জানান, কৃষকেরা এবার উৎপাদন খরচ বেশি হওয়া সত্ত্বেও পেঁয়াজ চাষে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ফলে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। পেঁয়াজের ফলনও হয়েছে খুব ভালো। এবার প্রতি বিঘায় কৃষকেরা ৬০ থেকে ৬৫ মণ পেঁয়াজ পাচ্ছেন। এ কারণে দাম কিছুটা কমে যাওয়ায় কৃষকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।