খাদ্যসহায়তার বদলে অক্সিজেন সিলিন্ডার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি

সিলেট নগরের আখালিয়া এলাকায় গত মঙ্গলবার বিকেলে করোনা আক্রান্ত এক নারীর বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেন শাহ আলম
ছবি: প্রথম আলো

সিলেটে পারিবারিক উদ্যোগে চলতি বছরের শুরু থেকে নগর ও শহরতলি এলাকায় গিয়ে ত্রাণসহায়তায় দিচ্ছিলেন শাহ আলম শাওন। সিলেটের বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ছেন তিনি। তাঁর বড় ভাই ও এক বোন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী। প্রবাসী ভাই ও বোনের সহযোগিতায় তিনি করোনায় কর্মহীন মানুষের এত দিন খাদ্যসামগ্রী দিচ্ছিলেন। তবে একটি ঘটনায় বদলে যায় তাঁর কার্যক্রম।

খাদ্যসামগ্রীর বদলে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ শুরু করার সেই ঘটনার বিষয়ে শাহজালাল উপশহর এলাকার ওই তরুণ শাহ আলম বলেন, গত ৫ জুলাই সিলেট শহরতলির ধূপাগুল এলাকার ষাটোর্ধ্ব সায়রা বেগমকে খাদ্যসহায়তা দিতে যান। ওই নারীর সংসারে একমাত্র মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না। ওই নারী শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন পরিমাপ করার পর তিনি বুঝতে পারেন তাঁর শরীরে অক্সিজেন কমে গেছে। পরে তাঁকে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে দেন। কিন্তু ওই নারী তিন দিন পর মারা যান।

হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় ওই সময় অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম বেড়ে যায়। অনেক দরিদ্র পরিবারের রোগীরা টাকার অভাবে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে বড় ভাই ও বোনের সঙ্গে আলোচনা করে ত্রাণ ও খাদ্যসহায়তার বদলে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিতরণের উদ্যোগ নেন তিনি। প্রথমে একসঙ্গে ১০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনেন। অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি চুক্তি করেন, যাতে সব সময় ও তাৎক্ষণিক তাঁদের কাছ থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার পান।

শাহ আলম বলেন, স্বল্প পরিসরে শুরু করায় প্রথম দিকে বিনা মূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ করার বিষয়ে তাঁরা তেমন প্রচারণা চালাননি। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেন তিনি। এরপর থেকে প্রতিদিনই অক্সিজেনের সহায়তা চেয়ে ফোন কল বাড়তে থাকে। জুলাই মাসের শেষ দিকে প্রায় প্রতিদিনই ১৫ থেকে ১৭টি ফোন আসত। ফোন পেলেই তিনি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটে যেতেন।

অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ায় একেক করে বাড়তে থাকে সিলিন্ডারের সংখ্যা। গতকাল বুধবার পর্যন্ত তিনি নিজ উদ্যোগে ৩৪টি অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং সরঞ্জাম কিনেছেন। এর মধ্যে ৫টি স্থায়ীভাবে চেয়ে নিয়ে গেছেন। বর্তমানে ২৯টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে তিনি সহায়তা করে যাচ্ছেন। অক্সিজেনের চাহিদা ও সহায়তা চেয়ে দিন–রাতে ফোন আসতে থাকায় পরিচিত ছোট ভাইদের নিয়ে নগরের মদিনা মার্কেট, আম্বরখানা, তালতলা ও দক্ষিণ সুরমায় ২০ জন স্বেচ্ছাসেবী সহযোগিতাকারী দল গঠন করেন। ২৪ ঘণ্টা  ০১৭১৭৭৯৪৮২২, ০১৭১৯৪০৫৩৫৫, ০১৭৫১৭১৮১৮৬—এই তিনটি মুঠোফোন নম্বরে ফোন করলেই অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া যাবে।  

সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে শাহ আলমের মাধ্যমে অক্সিজেন সেবা পাওয়া আমির উদ্দিন বলেন, ‘৮ আগস্ট ফোন দেওয়ার প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যেই অক্সিজেন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন শাহ আলম। আসার পরপরই প্রায় ৫ মিনিটের মধ্যেই তিনি অক্সিজেন লাগিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে চলে যান। আমার ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরই শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। হাসপাতালে শয্যা পেলেও পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ছিল না। হাসপাতালে অনেকেই নিজ উদ্যোগে সিলিন্ডার কিনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কিন্তু আমাদের সে অবস্থা ছিল না। এ জন্য পরিচিত একজনের কাছ থেকে শাহ আলমের মুঠোফোন নম্বর নিয়ে ফোন দিয়েছিলাম। ভাই এখন অনেকটা সুস্থ।’

শাহ আলমের অক্সিজেন সিলিন্ডার পেয়ে উপকৃত আরও সাতজন বলেন, ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা অক্সিজেন সিলিন্ডার পেয়েছেন।

শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্যসংকটের তুলনায় শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা মানুষের কষ্ট বেশি নাড়া দিয়েছে আমাকে। এ জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডারের সেবা দেওয়া শুরু করি। বুধবার দুপুর পর্যন্ত ১৮৬ জনকে অক্সিজেন সরবরাহ করেছি। অক্সিজেনের জন্য বেশির ভাগ ফোন আসে গভীর রাতে।’

‌সিলেটের ডেপু‌টি সি‌ভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত বলেন, কারোনায় আক্রান্ত রোগীদের হঠাৎই শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। অনেকের শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। অনেকেই বিনা মূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করছেন। সমাজের বিত্তবানরা য‌দি এগিয়ে আসেন, তবে করোনা রোগীরা আর শ্বাসকষ্টে ভোগান্তি পোহাবেন না।