খাল খননের মাটি উঠানে

ভরা বর্ষার আগে মাটি সরাতে না পারলে তা ধুয়ে হয় আবার খালে নামবে, না হয় রাস্তা, বসতবাড়ি, ফসলি জমি নষ্ট করবে।

বাড়ির রান্নাঘর, টিউবওয়েল ও টয়লেট চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে। মাটির স্তূপ জমে আছে বাড়ির উঠানে। দুটি ঘরের একটির তিন পাশে মাটির স্তূপ। মাটির সেই স্তূপের উচ্চতা পৌঁছে গেছে ঘরের চালার ওপর পর্যন্ত। ফলে বৃষ্টি হলে কাদামাটি ঢুকে পড়ছে থাকার ঘরে। দুই মাসের বেশি সময় ধরে এই ভোগান্তির মধ্যে আছেন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের চর রাঢ়িখালী গ্রামের বাসিন্দা শরিফউদ্দিন মোল্লা।

সম্প্রতি তাঁর বাড়ির কূল ঘেঁষে যাওয়া খালটি পুনঃখনন করেছে সরকার। কিন্তু খননের মাটি অপসারণ না করায় পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এই চাষি। শরীফ মোল্লার স্ত্রী তারা বিবি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। মাটি ফেলার সময় বাধা দিলেও তাঁরা শোনেননি। উঠানে কয়ডা আম, জাম, জামরুলগাছ ছিল, তা–ও মাটির তলে চলে গেছে। এখন মাটি সরাতি গেলি ভাটা আলারা হুমকি–ধমকি দেচ্ছে। তা ছাড়া এত মাটি আমরা কনে সরাব?’

খালের মাটি নিয়ে একই রকম সংকটের মধ্যে আছেন তাঁর প্রতিবেশী বছিরন নেছা, নান্নু মিয়া, রুবেল রানা, কাওড়া গ্রামের রোজিনা খাতুনসহ অসংখ্য মানুষ। কারও বাড়ি যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, কারও বসতবাড়ির দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে মাটির স্তূপ। আবাদি জমিও দখল হয়ে আছে কারও কারও। এমন অবস্থায় নিজেরা মাটি সরাতে গেলেও বিভিন্ন পক্ষের বাধার মুখে পড়ছেন ভুক্তভোগীরা।

মাগুরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ৬৪টি জেলার অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় সম্প্রতি মহম্মদপুর উপজেলার এমডি-১ খাল পুনঃখননের কাজ শেষ হয়েছে। উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের নারায়ণপুর নবগঙ্গা নদী থেকে শুরু করে চুড়ারগাতি হয়ে মধুমতী নদীতে মিলিত হয়েছে খালটি। প্রায় সাড়ে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি পুনঃখনন করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয় ৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও এর মধ্যেই কাজের ৯০ ভাগের বেশি শেষ হয়েছে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট স্থানীয় ঠিকাদারদের একজন আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুক্তির মধ্যে মাটি অপসারণের কোনো শর্ত ছিল না। পাউবো মাটি রাখার জন্য যেসব জায়গা দেখিয়ে দিয়েছে, সেখানেই ফেলা হয়েছে। এখানে ঠিকাদারের কোনো গাফিলতি নেই। আমরা যথাসম্ভব মানুষের ক্ষতি এড়িয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি।’

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, ভরা বর্ষার আগে মাটি সরাতে না পারলে তা ধুয়ে হয় আবার খালে নামবে, না হয় রাস্তা, বসতবাড়ি, ফসলি জমি নষ্ট করবে।

বিনোদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শিকদার মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক মানুষের জমি নষ্ট হয়েছে। মানুষের বাড়ি ও রাস্তার ওপর যত্রতত্র মাটি ফেলে রাখা হয়েছে। আমরা চাই যেসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এসব মাটি তাঁদের নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে দেওয়া হোক।’

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, খাল থেকে উত্তোলিত মাটির পরিমাণ পাঁচ লাখ ঘনমিটার। জেলা পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসব মাটি জনকল্যাণমূলক কাজে বা প্রতি ঘনমিটার ১০ টাকা করে বিক্রির নিয়ম রয়েছে।

এ বিষয়ে মাগুরা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারোয়ার জাহান বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে খননের মাটি ও এটি বিক্রি করে অর্জিত অর্থের হিসাব প্রকল্প পরিচালকের কাছে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জেলা পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ মাটি ১০ টাকা ঘনমিটার দরে বিক্রি করা যাবে। জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলে শিগগিরই এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ও জেলা পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আশরাফুল আলম বলেন, ‘এই মাটি জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে, এমন অসংখ্য অভিযোগ আমার দপ্তরে এসেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এ পর্যন্ত পাউবো এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে পাউবোকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।’