খাসিয়া-গারোদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় খাসিয়া ও গারোদের ওপর হামলা এবং সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের প্রতিবাদে আজ ঢাকার বাপার কার্যালয়ে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নে সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস, খাসিয়া ও গারো সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলা এবং তাদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। আজ রোববার ছয়টি সংগঠন ঢাকায় ভার্চ্যুয়ালি সংবাদ সম্মেলন করে এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানায়।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় খাসিয়াপুঞ্জির লোকজনের ওপর গত শুক্রবার বিকেলে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। এ ঘটনায় ছয়জন আহত হয়েছেন। এ নিয়ে আজ প্রথম আলোতে ‘খাসিয়াপুঞ্জির বাসিন্দাদের ওপর হামলা, আহত ৬’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর আজ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), নিজেরা করি ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) এ প্রতিবাদ সংবাদ সম্মেলন করে।

খাসিয়াপুঞ্জির লোকজন, বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্র জানায়, কর্মধা ইউনিয়নে দুর্গম বিভিন্ন টিলা এলাকায় ২৫টি পুঞ্জি রয়েছে। এসব পুঞ্জিতে ১০ সহস্রাধিক খাসিয়া ও গারো থাকে। এর মধ্যে ডলুছড়া পুঞ্জি এলাকায় ১০ হেক্টর জমির মালিকানা নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গে ওই পুঞ্জির খাসিয়াদের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। সম্প্রতি বন বিভাগের স্থানীয় মুরইছড়া বিটের উদ্যোগে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় বাগান করা হয়। ১০ আগস্ট বাগানের চারাগাছ উপড়ে ফেলার ঘটনা ঘটে।

এ ব্যাপারে বন বিভাগ ডলুছড়া পুঞ্জির লোকজনের বিরুদ্ধে কুলাউড়া থানায় মামলা করে। এর জেরে ১১ আগস্ট পাইকাররা ডলুছড়া পুঞ্জিতে পান কিনতে গেলে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির উপকারভোগীরা তাঁদের বাধা দেন। এ নিয়ে ডলুছড়াসহ আশপাশের বিভিন্ন পুঞ্জির লোকজনের সঙ্গে উপকারভোগীদের বিরোধ দেখা দেয়। ২৪ আগস্ট গভীর রাতে স্থানীয় ভেলুয়াপুঞ্জির পাঁচটি জুমের প্রায় তিন হাজার পানগাছ কর্তনের ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারেও পুঞ্জির পক্ষ থেকে কিছু উপকারভোগীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়।

২৭ আগস্ট দুপুরের দিকে ডলুছড়াপুঞ্জির পাশে ছোট কালাইগিরি এলাকায় পান তোলার সময় প্রতিপক্ষের লোকজন খাসিয়াদের বাধা দেন। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ওই দিন বিকেলে উপজেলা সদর থেকে কাজ সেরে বিভিন্ন পুঞ্জির লোকজন বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় দুপুরের ঘটনার জেরে উপকারভোগীরা তাঁদের ওপর হামলা চালান। এতে শিশুসহ ছয়জন আহত হন।

এসব ঘটনার প্রতিবাদে আজ বেলা ১১টার দিকে সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাপার সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। এতে সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির, এএলআরডির প্রধান নির্বাহী শামসুল হুদা, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, বাপার সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম, কুলাউড়ার আদিবাসী নেত্রী ফ্লোরা বাবলি তালাং প্রমুখ অংশ নেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাপার কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় খাসিয়া ও গারোদের ওপর হামলা এবং সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের প্রতিবাদে অয়োজিত ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন সুলতানা কামাল
ছবি: প্রথম আলো

সংবাদ সম্মেলনে খাসিয়া–গারোদের ওপর হামলার কঠোর সমালোচনা করে সুলতানা কামাল বলেন, ‘খাসিয়া-গারোরা এ দেশেরই নাগরিক। তারা বনকে রক্ষা করছে। কোনো আদিবাসী বনে বাস করে হঠাৎ করে লাখ-কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়ে যাননি। এ রকম উদাহরণ নেই। কিন্তু বনকে ব্যবহার করে বাইরের অনেকে সম্পদশালী হয়েছেন—এটার উদাহরণ আছে।’ সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস, খাসিয়া-গারোদের ওপর হামলা ও তাদের উচ্ছেদের চেষ্টার তিনি প্রতিবাদ জানান।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‌সিলেট অঞ্চলে জমি নিয়ে আদিবাসীদের সঙ্গে বন বিভাগ, চা-বাগান ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলছে। অথচ খাসিয়া-গারোদের ভূমির মালিকানা ঐতিহ্যগত। বংশপরম্পরায় তারা বনে বাস করছে। আন্তর্জাতিকভাবেও এ অধিকারের স্বীকৃতি আছে। সমতলের আদিবাসীদের ভূমির সমস্যা সমাধানের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানানো হচ্ছে। কিন্তু এখনো তা হয়নি। তবে স্থায়ী সমাধানের আগপর্যন্ত আদিবাসীদের জমি দখল না করাসহ তাদের এলাকায় কোনো প্রকল্প না নেওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটা নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।

প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে নতুন গাছ লাগানো বন বিভাগের কাজ নয়। বনায়ন আর বন রক্ষা করা দুটি আলাদা বিষয়। কুলাউড়ায় খাসিয়া-গারোদের ওপর নির্যাতনের আমরা নিন্দা জানাই
খুশী কবির, সমন্বয়ক, নিজেরা করি

নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, ‘প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে নতুন গাছ লাগানো বন বিভাগের কাজ নয়। বনায়ন আর বন রক্ষা করা দুটি আলাদা বিষয়। কুলাউড়ায় খাসিয়া-গারোদের ওপর নির্যাতনের আমরা নিন্দা জানাই।’

সংবাদ সম্মেলনে ফ্লোরা বাবলি তালাং তাঁদের এলাকার পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, নির্যাতনের ঘটনার পর থেকে স্থানীয় খাসিয়া-গারোরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তবে  প্রশাসন-পুলিশ তাদের অভয় দিয়েছে।

কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিনয় ভূষন রায় মুঠোফোনে বলেন, কর্মধায় খাসিয়াপুঞ্জি এলাকার পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। হামলার বিষয়ে উভয় পক্ষ থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।