‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ নারায়ণগঞ্জের বায়ু

ইটভাটার চুল্লি দিয়ে নির্গত কালো ধোঁয়া দূষিত করছে বাতাস। বায়ুদূষণের কারণে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রকমের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলী ফেরিঘাট এলাকায়
ছবি: দিনার মাহমুদ

ধলেশ্বরী নদীর দুই তীরে সারি সারি ইটভাটা। কয়লার আগুনে পোড়ানো হচ্ছে ইট। ভাটাগুলো থেকে অনবরত নির্গত কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আশপাশের এলাকার গাছপালা, বাড়িঘরের চালে পড়ে আছে লাল ধুলাবালুর আস্তরণ। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলী ইউনিয়নের প্রতাপনগর এলাকায় গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব ইটভাটা ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা কলকারখানা নারায়ণগঞ্জে বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। এদিকে একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় বাতাসে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের বায়ুর মান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। দূষণের দিক থেকে ঢাকা ও গাজীপুরের পরই এই জেলার অবস্থান। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের বায়ু মানের সূচক ছিল ২৮১। একই সময় গাজীপুরের ২০৪ ও ঢাকার মান ছিল ২৯৭। বায়ু মানের সূচক ২০০ অতিক্রম করলে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলে ধরা হয়।

বায়ু মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের বায়ু নারী, শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ ও অসুস্থদের জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’।

গত পাঁচ বছরে নারায়ণগঞ্জ সিটি এলাকায় বাতাসে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে। এই কার্বন নিঃসরণের জন্য বেশি দায়ী করা হয়েছে শিল্প খাতকে। জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লোকাল গভর্নমেন্ট ফর সাসটেইনেবিলিটির (ইকলি) করা এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি গত বছরের নভেম্বরে সিটি করপোরেশনে দাখিল করা হয়। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বার্ষিক কার্বন নিঃসরণ প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনাবিদ মঈনুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশন কার্বন নিঃসরণ কমাতে এলইডি বাতি স্থাপন, খাল ও জলাধার সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ধলেশ্বরীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা বক্তাবলী, এনায়েতনগর ও আশপাশের এলাকায় শতাধিকসহ পুরো জেলায় ইটভাটা রয়েছে তিন শ এর বেশি। এগুলোর মধ্যে ৮৬টি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে।

বক্তাবলী-এনায়েতনগর ইটভাটা মালিক সমিতি বলছে, একেকটি ভাটায় মৌসুমে কমপক্ষে ৫০ লাখ কাঁচা ইট পোড়ানো হয়। এ জন্য প্রতিদিন একটি ইটভাটায় প্রয়োজন হয় কমপক্ষে তিন টন কয়লা। অধিকাংশ ইটভাটা লোকালয়, ফসলি জমি ও নদীর পাশে অবস্থিত।

বক্তাবলী-এনায়েতনগর ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি শওকত আলী বলেন, জিগজ্যাগ প্রযুক্তি ব্যবহার করায় আগের তুলনায় ইটভাটা থেকে বায়ুদূষণ কম হচ্ছে। আস্তে আস্তে তাঁরা ব্লকের তৈরি ইটের দিকে যাবেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জেলায় চুন কারখানা আছে ১২টি। এগুলোর মধ্যে ছয়টি অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। যানবাহনের কালো ধোঁয়াও নারায়ণগঞ্জে বায়ুদূষণের আরেক কারণ। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের সময় ধুলাবালি বাতাসে ছড়িয়ে দূষণ বাড়ছে। এসব নির্মাণকাজে নিয়মিত পানি ছিটানোর শর্ত থাকলেও সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না। এ ছাড়া সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহৃত ফ্লাইএ্যাশ জাহাজ থেকে ওঠানোর সময় বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে রি-রোলিং স্টিল মিল থেকে লোহা গলানোর বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ শাখার সভাপতি এ বি সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন। দূষণরোধে পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। তিনি সিটি করপোরেশন এলাকায় ধুলাবালু রোধে নিয়মিত পানি ছিটানোর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ দপ্তরের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, যেসব কারখানায় ডাস্ট কালেক্টর নেই, সেগুলোতে লাগানোর নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া পরীক্ষার জন্য জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের স্মোক মিটার নেই। আর জনবলসংকটের কারণে নির্মাণকাজে নজরদারি ঠিকমতো করা সম্ভব হয় না।

ইটভাটায় কাজ করে সপ্তাহে ১ হাজার ৫০০ টাকা পান শ্রমিক জোবেদা আক্তার। তিনি বলেন, তাঁর সারা বছর সর্দি ও কাশি লেগে থাকে। ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খান। যা আয় করেন তাঁর অনেকাংশ ওষুধে চলে যায়। ইটভাটার আরও ১২ জন শ্রমিক প্রায় একই সমস্যার কথা বলেছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সেখানে ব্রঙ্কাইটিস ও অ্যাজমার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাঁদের হাসপাতালে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন ৬০-৭০ জন চিকিৎসা নিতে আসেন। আগে শীতে এই প্রকোপ বেশি দেখা দিলেও এখন সারা বছরই শ্বাসকষ্টজনিত রোগী পাওয়া যাচ্ছে।