খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মৃত্যু নিয়ে রহস্য

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মো. সেলিম হোসাইন
ছবি: সংগৃহীত

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক মো. সেলিম হোসাইনের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। মারা যাওয়ার আগে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা তাঁকে মানসিক নিপীড়ন করেছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মো. সেলিম হোসাইন (৩৮ ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও লালন শাহ হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করছে।

ওই শিক্ষকের মারা যাওয়ার ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটন ও জড়িত ব্যক্তিদের বিচারসহ কয়েকটি দাবিতে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষক সমিতি। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরাও ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে বুধবার সকালেও কোনো শিক্ষক ও শিক্ষার্থী শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেননি।

বিষয়টি নিয়ে বুধবার দুপুর ১২টার দিকে সাধারণ সভা করে শিক্ষক সমিতি। ওই সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রতীক চন্দ্র বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্বার বাংলার পাদদেশে প্রতিবাদ সভা এবং কালো ব্যাজ ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যতক্ষণ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার না হয় এবং তাঁদের স্থায়ীভাবে ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কার করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষকেরা একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবেন বলে শিক্ষক সমিতির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া সভায় ওই শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনায় দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

এ বিষয়ে ছাত্রকল্যাণ পরিষদের পরিচালক অধ্যাপক ইসমাঈল সাইফুল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতেই তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দ্রুত তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে রাজনৈতিক উত্তেজনা শুরু হয়েছে। নতুন কমিটি আসার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কয়েকটি উপদলে ভাগ হয়ে গেছে। এর ভেতর একটি প্রভাবশালী অংশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

সম্প্রতি কুয়েটের লালন শাহ ছাত্র আবাসিক হলের ডিসেম্বর মাসের ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচন নিয়ে সাধারণ সম্পাদক সাদমানের পক্ষের বিরুদ্ধে ম্যানেজার নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার অভিযোগ ওঠে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাদমানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের ওই অংশটি ক্যাম্পাসের রাস্তা থেকে অধ্যাপক সেলিম হোসাইনকে জেরা করা শুরু করে। পরে তাঁরা শিক্ষককে অনুসরণ করে তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষে (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) প্রবেশ করেন। সে সময় তাঁরা তাঁর ওপর মানসিক নিপীড়ন চালান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান  প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা পক্ষ ইস্যুটাকে ডাইনিংয়ের দিকে ফোকাস করার চেষ্টা করছে। সেলিম স্যার প্রায় ৯ মাস আগে লালন শাহ হলের দায়িত্ব পেয়েছেন। হলে যিনিই প্রভোস্টের দায়িত্ব পান, আমরা অফিসিয়ালি তাঁর সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু করোনার কারণে স্যারের সঙ্গে আগে দেখা করা হয়নি। এ ছাড়া বিজয়ের মাসে নানা কর্মসূচি থাকে, সে জন্যও স্যারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। স্যারই আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। আমি ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে সেখানে যাইনি। আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকল্যাণ কমিটির সদস্যসচিব। সে হিসেবেই সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে স্যারের সঙ্গে একেবারে স্বাভাবিক কথাবার্তাই হয়েছিল। স্যারসহ আমরা হাসিমুখেই বের হয়েছি। একটা অংশ এটাকে ভিন্ন খাতে নেওয়া চেষ্টা করছে।’

ওই শিক্ষকের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার বেলা দুইটার কিছু আগে শিক্ষক সেলিম হোসাইন দুপুরে খাবার খাওয়ার জন্য বাসায় যান। পরে তাঁর স্ত্রী লক্ষ করেন তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। এরপর পরিবারের সদস্যরা দরজা ভেঙে তাঁকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। এ সময় সেখানে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ বিষয়ে শিক্ষক সেলিম হোসাইনের স্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ সকালে নাশতা সেরে বের হওয়ার সময় তিনি আমাকে বেলা সোয়া একটার দিকে দুপুরের খাবার প্রস্তুত রাখতে বলে যান। আড়াইটা থেকে তাঁর ক্লাস ছিল। আমি টেবিলে খাবার প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। দুইটার কিছু আগে তিনি বাসায় ফিরে গোসল করতে যান। বেশ কিছু পরে আমার মেয়ে বাথরুমের পাশে গিয়ে তাঁর বাবাকে বারবার ডাকতে থাকে। কোনো রকম সাড়া না পাওয়ায় আমরা তিনতলা ও দুইতলার গার্ডদের ডেকে দরজা ভেঙে দেখি বাথরুমের মধ্যে তিনি নিথর অবস্থায় পড়ে আছেন। এরপর আমার আর কোনো হুঁশ ছিল না।’

সেলিম হোসাইনের স্ত্রী আরও বলেন, তাঁর স্বামীর উচ্চ রক্তচাপ ছাড়া কোনো সমস্যা ছিল না, তা–ও নিয়ন্ত্রণে ছিল। লোকমুখে এখন তিনি শুনছেন বাসায় আসার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সঙ্গে কী যেন ঝামেলা হয়েছিল।