খুলনায় চিকিৎসক লাঞ্ছিতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩, কর্মবিরতি প্রত্যাহার

খুলনা করোনা ডেডিকেটেট হাসপাতালের চিকিৎসক সুমিত পালকে লাঞ্ছনার প্রতিবাদে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন খুলনা জেলা শাখা সংবাদ সম্মেলন করে। খুলনা বিএমএ ভবনের কাজী আজহারুল হক মিলনায়তনে আজ দুপুরেপ্রথম আলো

খুলনায় করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসক লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী চিকিৎসক সুমিত পাল ও হাসপাতালের পরিচালক এ টি এম মঞ্জুর মোর্শেদ বাদী হয়ে পাঁচজনকে আসামি করে দুটি মামলা করেন। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে আজ বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) খুলনা শাখা।

পরে মামলার তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্মবিরতি কর্মসূচি আর থাকছে না বলে বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন বিএমএ খুলনার সভাপতি শেখ বাহারুল আলম।

আজ ভোরেই পৃথক অভিযান চালিয়ে মামলার প্রধান আসামি সাইফুল ইসলাম (২৫) ও মো. বশির উদ্দিনকে (৩৮) বাগেরহাট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোনাডাঙ্গা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মমতাজুল হক দুপুরের পর বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করে বলেন, চিকিৎসক সুমিত পালের ওপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে মৃত রোগী রফিকুল ইসলামের ছেলে সাইফুল ইসলাম ও শ্যালক বশির উদ্দিনকে আজ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মেয়ের জামাই বদিউজ্জামানকে আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জের ওই করোনা রোগী ৩ এপ্রিল বেলা দুইটায় করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের ৪ নম্বর শয্যায় ভর্তি হন। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। তাঁকে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা (এইচএফএনসি) অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। রাত সাড়ে নয়টার দিকে রোগীটি মারা যান। রোগীর মৃত্যুসনদ লেখার সময় রোগীর ছেলে ও স্বজনেরা চিকিৎসক সুমিত পালের ওপর আক্রমণ করেন।

এর আগে চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদ ও কর্মস্থলের নিরাপত্তার দাবিতে দুপুরে নগরের বিএমএ ভবনের কাজী আজহারুল হক মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন চিকিৎসক নেতারা। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে কোভিড চিকিৎসাসহ সব জরুরি সার্ভিস চালু রেখে কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেন তাঁরা।

৩ এপ্রিল খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত রোগী রফিকুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর স্বজনেরা সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক সুমিত পালের ওপর হামলা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ওই চিকিৎসক এখন আহত অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

১০০ শয্যার একটি কোভিড ওয়ার্ড চালাতে গেলে যে পরিমাণ জনবলের প্রয়োজন, যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি, ওয়ার্ডবয়-আয়া প্রয়োজন, তা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে রোগীর স্বজনেরা মনে করছেন, চিকিৎসকেরা এর জন্য দায়ী। করোনার মতো এ রকম পরিস্থিতিতে যদি চিকিৎসকেরা আতঙ্কিত পরিবেশে থাকেন, তবে তাঁরা কোভিডের ডিউটি করতে চাইবেন না।
শেখ বাহারুল আলম, বিএমএ খুলনা শাখার সভাপতি

সংবাদ সম্মেলনে বিএমএ খুলনা শাখার নেতারা বলেন, কর্তব্যরত একজন চিকিৎসকের ওপর হামলা কোভিড হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে ভাবিয়ে তুলছে। আত্মরক্ষার জন্য চিকিৎসকেরা ঝুঁকিপূর্ণ কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিতে বিরত থাকা শুরু করলে খুলনায় ভয়াবহ চিকিৎসা বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

বিএমএ খুলনা শাখার সভাপতি শেখ বাহারুল আলম বলেন, ‘১০০ শয্যার একটি কোভিড ওয়ার্ড চালাতে গেলে যে পরিমাণ জনবলের প্রয়োজন, যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি, ওয়ার্ডবয়-আয়া প্রয়োজন, তা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে রোগীর স্বজনেরা মনে করছেন, চিকিৎসকেরা এর জন্য দায়ী। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন যে করোনার এই অতিমারির সময়ে অন্তত স্পর্শকাতর হাসপাতালগুলো নিরাপদ রাখা হোক। করোনার মতো এ রকম পরিস্থিতিতে যদি চিকিৎসকেরা আতঙ্কিত পরিবেশে থাকেন, তবে তাঁরা কোভিডের ডিউটি করতে চাইবেন না।’

গত ৩ এপ্রিল মারা যাওয়া ওই রোগীর চিকিৎসায় কোনো অবহেলা ছিল কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএমএর সাধারণ সম্পাদক মো. মেহেদী নেওয়াজ বলেন, বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জের ওই করোনা রোগী ৩ এপ্রিল বেলা দুইটায় করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের ৪ নম্বর শয্যায় ভর্তি হন। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। তাঁকে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা (এইচএফএনসি) অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। চিকিৎসক সুমিত পালসহ নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরলসভাবে তাঁকে চিকিৎসাসেবা দেন। রাত সাড়ে নয়টার দিকে রোগীটি মারা যান। রোগীর মৃত্যুসনদ লেখার সময় রোগীর ছেলে ও স্বজনেরা সুমিত পালের ওপর আক্রমণ করেন। যাঁরা সরাসরি এই ঘটনায় জড়িত, তাঁদের গ্রেপ্তার করা না হলে চিকিৎসকেরা কেউ কাজে যোগ দেবেন না।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন খুলনা বিএমএর সভাপতি ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি শেখ বাহারুল আলম, সাধারণ সম্পাদক মো. মেহেদী নেওয়াজ, যুগ্ম সম্পাদক বঙ্গ কমল বসু, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মামুন অর রশীদ, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এ টি এম মঞ্জুর মোর্শেদ প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসক সুমিত পালের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করার পাশাপাশি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা, কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালসহ জরুরি সেবায় নিয়োজিত হাসপাতালগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা, চিকিৎসার প্রয়োজনে উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রের কাছে দায়মুক্তি ভোগ নিশ্চিত করার দাবি জানান চিকিৎসক নেতারা।

সোনাডাঙ্গা মডেল থানার ওসি মমতাজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এই ঘটনায় বাকি আসামিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।