খুলনায় তরমুজ আবাদে ধস

খুলনার তরমুজচাষিদের কাঁধে এখন কষ্টের ভার। আমনের দরপতনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তরমুজ নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখা চাষিদের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। অসময়ে অতিবৃষ্টি ও দফায় দফায় বৃষ্টির কারণে এ বছর তরমুজ আবাদে ধস নেমেছে। অনেক চাষি এরই মধ্যে মূলধন হারিয়ে খেত ছেড়ে দিয়েছেন। বেশির ভাগই খরচের টাকা তুলতে পারা না–পারাটা এখন ছেড়ে দিয়েছেন ভাগ্যের ওপর।

আগের মৌসুমে জেলায় প্রায় ১৩৫ কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদিত হলেও এ বছর ৪০ কোটি টাকার বেশি হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তরমুজচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত তরমুজ চাষের মৌসুম শুরু ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারি। কিন্তু এ সময় জেলার তরমুজ চাষের অধিকাংশ জমিতে কাদা ভাব থাকায় মাসখানেক দেরিতে তরমুজ চাষ করেন কৃষকেরা। চলতি মৌসুমে ২৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি টানা বৃষ্টি হয়। সে সময় অনেক জমি চাষ দেওয়া ছিল, কিছু জমিতে বীজ বোনা হয়েছিল আর কিছু জমিতে চারা গজিয়েছিল। ওই সময় খেত ডুবে থাকায় জমিতে আর বীজ গজায়নি, অনেক জমিতে চারা পচে যায়। পরে আবার নতুন করে বীজ বুনলেও ঠিকমতো হয়নি। গত মাসখানেকের ভেতর কয়েক দফা বৃষ্টিতে বারবার ফসল নষ্ট হয়েছে।

চাষিরা জানান, এমনিতেই একটু দেরি করে ওঠে খুলনার তরমুজ। এ বছর ফলন পেতে আরও দেরি হবে। এরই মধ্যে কোনো কোনো চাষি চালান হারিয়ে একেবারে মাঠ ছেড়েছেন। যেভাবে মাঝেমধ্যে ঝড়বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত ফসল ঘরে তোলা ও দেরিতে ফলন ওঠায় দাম পাবেন কি না, তা নিয়ে চরম শঙ্কা কাজ করছে।

>২০১৯ সালে খুলনা জেলায় তরমুজ চাষ
৩০০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল
১৬৬৫ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ
৯৫০ হেক্টর জমির ফসল রক্ষা
১৩৫ কোটি টাকার উৎপাদন আগের বছর
৪০ কোটি টাকার বেশি উৎপাদন সম্ভব নয় এবার

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, খুলনা বিভাগের মধ্যে খুলনা জেলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজের চাষ হয়। বছর বিশেক ধরে আবাদ হলেও ২০১৪ সালে জেলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজের আবাদ হয়। ওই বছর জেলায় ৩ হাজার ৪৬৮ হেক্টর জমিতে তরমুজ হয়েছিল। তরমুজ আবাদে অন্যতম সুপরিচিত এলাকা দাকোপ। জেলার মোট উৎপাদিত তরমুজের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ চাষ হয় এই উপজেলায়। এখানকার চার হাজারের বেশি মানুষ এই ফসল আবাদের সঙ্গে জড়িত। দাকোপের বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ৩০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দাকোপের অধিকাংশ কৃষিজমি একসময় এক ফসলি ছিল। ১৯৯৫ সালের দিকে কিছু জমিতে তরমুজের চাষ করা হলেও পরিমাণে তা ছিল খুবই কম। কিন্তু সিডরে এলাকার কৃষক বড় ধাক্কা খান। এরপর আয় বাড়াতে এলাকায় তরমুজ চাষ বাড়তে থাকে।

গত বছর এ উপজেলায় ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে ৮৫ কোটি টাকার বেশি তরমুজ উৎপাদিত হয়েছে। চলতি বছর উপজেলায় তরমুজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল দুই হাজার হেক্টর। ৯১৭ হেক্টর জমিতে আবাদও করা হয়েছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহে টানা বৃষ্টিপাতে ৬০০ হেক্টর জমির তরমুজ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। পরে দফায় দফায় বৃষ্টিতে আরও ১০০ হেক্টরের মতো ফসল নষ্ট হয়েছে। ফলে গত মৌসুমের তুলনায় প্রায় ১০ ভাগের ১ ভাগ জমি থেকে এবার ফসল উঠবে।

গত সপ্তাহে সরেজমিন দেখা গেছে, মাঠ অনেকটা ফাঁকা, মাঠের বেশির ভাগ জায়গায় গবাদিপশু চরছে। বেঁচে থাকা তরমুজ গাছগুলো এখনো ছোট। কিন্তু ছোট ছোট গাছেই ফুল এসেছে। কিছু গাছে মাত্র ফল এসেছে। খেত ঘিরে মৌসুমের এই সময় যে রকম প্রাণচাঞ্চল্য থাকে, তা নেই। দাকোপের কালিকাবাটি গ্রামের কৃষক চিত্তরঞ্জন বলেন, ‘অন্য বছর এ সময় ফল ওঠার মতো হয়। আমরা শেষ সময়ের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটাই। আর এবার সব মরে প্রায় শূন্য খেত। অনেক চাষি ঘরে উঠে গেছে। আমার যতটুকু আছে, তা নিয়েই চালান বাঁচানোর আশায় আছি।’ দাকোপের পশ্চিম বাজুয়া গ্রামের দীপংকর মণ্ডল ২৫ বিঘা জমিতে আবাদ করেছিলেন। ইতিমধ্যে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। গাছ বেঁচে আছে ১০ বিঘার মতো জমিতে।

একই গ্রামের আরেক চাষি সুষমা মণ্ডল বলেন, গতবার তিন বিঘার খেতে লাভ হয়েছিল দেড় লাখ টাকার মতো। এবার ছয় বিঘা জমিতে লাগিয়েছিলেন। এর মধ্যে চার বিঘা ইজারা নিয়ে। বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘ফসল এবার জ্যৈষ্ঠের আগে উঠবে না। তখন বাজারে আম, জাম থাকবে। তরমুজের চাহিদা কেমন থাকবে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে যদি অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি না হয়; আর জ্যৈষ্ঠে ভালো গরম পড়ে, তবে হয়তো আসল টাকাটা তুলতে পারব।’

কৈলাশগঞ্জের ধোপাদী গ্রামের লিটন জোয়াদ্দার ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেছিলেন। এখন অল্প কিছু আছে। এ বছর দুই-তিনবার বীজ কিনতে হয়েছে তাঁর।

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পঙ্কজ কান্তি মজুমদার বলেন, প্রাকৃতিক কারণে গতবারের তুলনায় এবার তরমুজের উৎপাদন ব্যাপক কম হবে। তরমুজচাষিরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।