খুলনায় রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া, কেটে গেছে ঘূর্ণিঝড়ের ভয়

উপকূল এলাকা খুলনার কয়রা সকাল থেকে রোদ্রৌজ্জ্বল। মদিনাবাদ, কয়রা, খুলনা
সাদ্দাম হোসেন

রাতের জোয়ারে কী হয়, কী হয়—এমন দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিল উপকূলের মানুষ। আজ বৃহস্পতিবার সকালের রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া আর মানুষের কর্মব্যস্ততা জানান দিচ্ছে, কেটে গেছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব। রাতের জোয়ারে দুপুরের মতো পানি বাড়েনি, এ কারণে নতুন করে কোথাও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

যেকোনো বড় ঝড়কে খুব বেশি পাত্তা দেয় না উপকূলের মানুষ। জন্ম থেকে সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা মানুষের বড় ভয় বাঁধ নিয়ে। কারণ, একবার বাঁধ ভেঙে গেলে আর কিছুই করার থাকে না তাঁদের। এ কারণে বাঁধ ভাঙার আগপর্যন্ত সম্মিলিতভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে যায় তারা। গতকাল বুধবার দুপুরের জোয়ারের পানি ঠেকাতে এমন চেষ্টা দেখা গেছে কয়রার প্রায় প্রতিটি এলাকায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, গতকাল দুপুরে জোয়ারের পানি বেড়েছিল ৭ থেকে ৮ ফুট। এ কারণে বাঁধ উপচে ও পানির চাপে কয়েকটি স্থানের বাঁধ ভেঙে গেছে। বিকেল থেকেই স্থানীয় মানুষের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যদিকে রাতের জোয়ারে পানির উচ্চতা কমে গিয়েছিল। উচ্চতা হয়েছিল ৫ থেকে ৬ ফুট। এ কারণে বাঁধের আর কোনো ক্ষতি হয়নি।

জোয়ারের পানি না বাড়লেও সারা রাতই ছিল দমকা হাওয়া ও থেমে থেমে বৃষ্টি। তবে তা ভয় সৃষ্টি করার মতো নয়। এ কারণে উপকূলের মানুষ মনে করছে, এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। সবচেয়ে বড় জোয়ারটি ঠেকিয়ে দেওয়া গেছে।

খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, মূল ঝড়ের ভয় আর নেই। তবে মাঝেমধ্যে দমকা হাওয়া ও বৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কসংকেত কমানো হয়নি। এখনো ৩ নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত রয়েছে। জোয়ারের পানি আর আগের মতো বাড়বে না।

খুলনার উপকূলীয় উপজেলা ধরা হয় কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটাকে। গতকাল দুপুরের জোয়ারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়রা উপজেলা। ওই উপজেলার চারটি ইউনিয়নে অন্তত ১০টি স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। আর বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে—এমন স্থানের সংখ্যা আরও অন্তত ১৫।

কয়রা উপজেলাটির চার পাশ নদীবেষ্টিত। উপজেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ১৫৫ কিলোমিটারের মতো। এর আগে আইলা, সিডর, বুলবুল ও আম্পানে উপজেলার ব্যাপক ক্ষতি হয় ওই উপজেলায়।

শুরু থেকেই ঝড়ের কোনো প্রভাব ছিল না কয়রায়। গত মঙ্গলবার রাতের জোয়ারও ঠেকিয়ে দেয় এলাকাবাসী। তবে গতকাল দুপুরের জোয়ারে আর শেষরক্ষা হয়নি। পানি যত বেড়েছে, কোদাল আর প্লাস্টিকের বস্তা নিয়ে মানুষ তত পানি আটকানোর চেষ্টা করেছে। তারপরও বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রায় চার কিলোমিটারের মতো বাঁধ ভেঙে গেছে। দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের শাকবাড়িয়া নদীর আংটিহারা, বীণাপাণি এলাকা, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের একই নদীর গাতিরঘেরি, পদ্মপুকুর এলাকা, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কয়রা নদীর তেঁতুলতলা, চৌকনি, শিংয়েরচর এলাকা এবং মহারাজপুর ইউনিয়নের কয়রা নদীর পবনা ও মঠবাড়ি এলাকা এবং কপোতাক্ষ নদের দশালিয়া এলাকার বাঁধ ভেঙে গেছে।

কয়রা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাগর হোসেন বলেন, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গিয়ে ৫ হাজার ৮৫০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক বিধ্বস্ত বাড়ির সংখ্যা ১ হাজার ২০০। আর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৫০টির মতো ঘর। আশ্রয়কেন্দ্রে ৫ হাজার ২০০ মানুষ রয়েছেন।

এ ছাড়া পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। বাঁধের কিছু ক্ষতি হলেও তা স্থানীয় মানুষের সহায়তায় মেরামত করা হয়েছে।

পাইকগাছার গড়াইখালী ইউনিয়নের কুমখালী গ্রামের শান্ত মণ্ডল বলেন, দুপুরে জোয়ারের পানি শিবসা নদীর বাঁধের অন্তত এক ফুট ওপরে ছিল। এলাকার মানুষ খুব দুশ্চিন্তায় ছিল বাঁধ নিয়ে। বেলা দুইটার দিকে ভাটায় পানি কমতে শুরু করায় ওই ভয় কেটে যায়। তবে রাতের জোয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু ওই সময় জোয়ারের পানি দুপুরের তুলনায় কম হওয়ায় খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, কয়রার মানুষের বড় চিন্তা বেড়িবাঁধ। ষাটের দশকের ওই বাঁধের অর্ধেকেরও বেশি এখন ঝুঁকিপূর্ণ, এ কারণে নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লেই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। কয়রার মানুষ ত্রাণ চায় না, তারা চায় টেকসই বেড়িবাঁধ।

কয়রা উপজেলাটি পড়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাতক্ষীরা অঞ্চলের বিভাগ-২–এর আওতায়। ওই বিভাগের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান বলেন, রাতে জোয়ারের পানি খুব বেশি বাড়েনি, এ কারণে আর নতুন করে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। সকাল থেকেই যেসব স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে, সেখানে এলাকাবাসীর সহায়তায় কাজ করা হচ্ছে। দু–এক দিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের জরিপ করে সংস্কার করা হবে।