খোলা আকাশের নিচে দলবেঁধে চাকরির প্রস্তুতি

একজন দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর বলে দিচ্ছেন। বাকিরা নিজেদের উত্তরপত্রের সঙ্গে তা মিলিয়ে নিচ্ছেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঠাকুরগাঁও শহরের সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের বড়মাঠে।
ছবি: প্রথম আলো

‘২১-এর ৪, ২২-এর ২, ২৩-এর ১, ২৪–এর ২, ২৫-এর ...’ মাঠের কোণে বলিষ্ঠ উচ্চারণে এমন সুর শুনে থমকে দাঁড়ান অনেক পথচারী। ব্যস্ততার মধ্যেও একটুখানি দাঁড়িয়ে লোহার গ্রিলের ফাঁকে উঁকি দিয়ে সুরের উৎস খোঁজেন কেউ কেউ। উৎসের সন্ধান পেয়ে একটুখানি মুচকি হেসে চলতে শুরু করেন পথচারীরা। এটি মূলত চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা শেষে বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রের সঙ্গে উত্তরপত্র মিলিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা।

শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঠাকুরগাঁও শহরের সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের বড়মাঠে ৬০ জনের একটি দলকে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে। বৃত্তাকারে বসা সবার হাতে বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তরপত্র। আর তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ উচ্চারণে সঠিক উত্তরটি বলে দিচ্ছেন একজন। বাকিরা নিজ নিজ উত্তরপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছেন। সবাই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। বয়স ২২ থেকে ২৬ বছর। একই মাঠে কয়েকটি দল দেখা গেল। যাঁরা সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার পাঠ নিয়েও আলোচনা করছিলেন।

দল বেঁধে চাকরির পরীক্ষার এমন প্রস্তুতিকে তাঁরা বলছেন ‘স্টাডি গ্রুপ’। গ্রুপের মূল দায়িত্বে আছেন ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সোহেল রানা। তিনি বলেন, মাস চারেক আগে সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের সম্মান চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ রানা, ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ময়না আক্তারসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী দল বেঁধে পরীক্ষার প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। বিষয়টি তাঁকে জানালে তিনিও সম্পৃক্ত হন। পরে নিজের কলেজসহ অন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গ্রুপের জন্য পরিচালনা পরিষদ গঠন ও কর্মপন্থা ঠিক করেন।

বর্তমানে এই গ্রুপে ১৩০ জন সদস্য আছেন। তবে পরীক্ষায় নিয়মিত অংশ নেন ৬৫ থেকে ৮০ জন।

বিভিন্ন চাকরির প্রস্তুতির জন্য শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তৈরি করেছেন সিলেবাস। সেই অনুসারে সপ্তাহের পাঁচ দিন শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নেন। আর শুক্রবার সকালে চলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার পর মূল্যায়ন পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করার দায়িত্ব পালন করেন ‘স্টাডি গ্রুপ’ পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা। উত্তরপত্র ছাপার জন্য পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রত্যেককে ১০ থেকে ১৫ টাকা দিতে হয়। পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা নিজের উত্তরপত্র নিজেই মূল্যায়ন করেন। সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীকে করতালি দিয়ে অভিবাদন জানানো হয়। বর্তমানে এই গ্রুপে ১৩০ জন সদস্য আছেন। তবে পরীক্ষায় নিয়মিত অংশ নেন ৬৫ থেকে ৮০ জন।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, সাধারণত কঠিন বিষয়গুলো নিয়েই দলে আলোচনা করা হয়। যেসব বিষয় সহজে মাথায় ধরে না, তা অনেক শিক্ষার্থীই এড়িয়ে যান। ফলে পরীক্ষায় ভালো ফল করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। দল বেঁধে পড়ালেখায় সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা বেরিয়ে আসে। একজন একটা বিষয় বুঝতে না পারলে অন্যজন বুঝিয়ে দিতে পারেন।

‘স্টাডি গ্রুপের’ সাফল্য ইতিমধ্যে আসতে শুরু করেছে বলে জানালেন বেশ কয়েকজন চাকরিপ্রত্যাশী। সোহেল রানা বলেন, এই দল থেকে এলজিইডিতে একজনের চাকরি হয়েছে। বিভিন্ন দপ্তরের মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন ১৬ জন। সামনেই বিসিএস ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা। ওই সব পরীক্ষায় এই গ্রুপ থেকে অনেকেই ভালো ফল করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

চাকরিপ্রত্যাশীদের চলছে গ্রুপ স্টাডি। শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঠাকুরগাঁও শহরের সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের বড়মাঠে।
ছবি: প্রথম আলো
তথ্য আদান-প্রদানের বড় একটা কৌশলই হচ্ছে গ্রুপ স্টাডি। এর অন্যতম সুবিধা হলো যিনি বিষয়টি বোঝেন, তিনি অন্যদেরও তা বুঝিয়ে দেন। এতে তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগ দেখে তিনি অনুপ্রাণিত।
মো. আবু বক্কর সিদ্দিক, অধ্যক্ষ, ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজ

দল বেঁধে পাঠ আলোচনা করায় আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে মোহাম্মদ রায়হানের। তাঁর ভাষ্য, এত দিন একা একা বাড়িতে থেকে চাকরির পড়ালেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু জটিল বিষয়গুলোর সমাধান নিয়ে হতাশায় ছিলেন। এখন গ্রুপ স্টাডি করে যেকোনো চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে তিনি আত্মবিশ্বাসী।

একা একা পড়লে নিজের ভুলগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয় বলে মনে করেন গ্রুপের আরেক সদস্য ফারজানা বেগম। বলেন, ‘গ্রুপ স্টাডিতে ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সমাধানও পেয়ে যাচ্ছি।’

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, তথ্য আদান-প্রদানের বড় একটা কৌশলই হচ্ছে গ্রুপ স্টাডি। এর অন্যতম সুবিধা হলো যিনি বিষয়টি বোঝেন, তিনি অন্যদেরও তা বুঝিয়ে দেন। এতে তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগ দেখে তিনি অনুপ্রাণিত।