গঠিত ৮২টি পিআইসির মধ্যে পাঁচটির কাজ শুরু

নির্ধারিত সময়ের অন্তত ৪০ দিন পেরিয়ে গেলেও নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারকাজের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) গঠনকাজ সম্পূর্ণ শেষ হয়নি। এ ছাড়া গঠিত ৮২টি পিআইসির মধ্যে মাত্র ৫টির কাজ উদ্বোধন হয়েছে। জেলায় এবার ১২০টি পিআইসি গঠন করার কথা রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নীতিমালা অনুযায়ী, গত ৩০ নভেম্বরের মধ্যে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে জরিপকাজ, প্রাক্কলন ও পিআইসি গঠনের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। এ ছাড়া ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শুরু করে, তা ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরুই হয়নি। এতে শঙ্কায় আছেন ওই অঞ্চলের কৃষকেরা। কৃষকেরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ শুরু করতে না পারলে অকাল বন্যায় ফসলহানির আশঙ্কা থাকে।

জেলা পাউবো, প্রশাসন ও হাওর অঞ্চলের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেত্রকোনার খালিয়াজুরি, মোহনগঞ্জ, মদন ও কলমাকান্দা উপজেলায় আংশিক এলাকা মূলত হাওরাঞ্চল। হাওরের একমাত্র ফসল বোরো। এই ফসলের ওপরই নির্ভর করে কৃষকদের সারা বছরের সংসার খরচ, চিকিৎসা, সন্তানদের পড়ালেখা ও আচার–অনুষ্ঠান। জেলায় ছোট–বড় মোট ১৩৪টি হাওর রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খালিয়াজুরিতে ৮৯টি হাওর। হাওরাঞ্চলে ৩১০ কিলোমিটার ডুবন্ত (অস্থায়ী) বাঁধের মধ্যে খালিয়াজুরিতে ১৮১ কিলোমিটার ডুবন্ত অস্থায়ী বাঁধ আছে। ওই বাঁধের ওপর স্থানীয় কৃষকদের ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি জমির বোরো ফসলের আবাদ নির্ভর করে। পাউবো ও স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে কাজ হয়। ২০১৭ সালের বন্যায় ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পরে নতুন নীতিমালা করে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে সরাসরি যুক্ত করা হয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে। জেলা প্রশাসককে জেলা কমিটির সভাপতি ও পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্যসচিব করা হয়। ইউএনওকে উপজেলা কমিটির সভাপতি ও উপসহকারী প্রকৌশলীকে সদস্যসচিব করা হয়।

বাঁধের কাজ শেষ করার জন্য স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে গণশুনানির মাধ্যমে পাঁচ থেকে সাতজন নিয়ে পিআইসি কমিটি গঠন করার কথা। এসব কমিটি বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ করবে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পিআইসি কমিটি গঠন করে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণ ও সংস্কারকাজ শুরু করার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের এক মাস পর আজ শুক্রবার পর্যন্ত ৮২টি পিআইসি গঠন করা হয়। এর মধ্যে খালিয়াজুরিতে ৫০টি, মোহনগঞ্জে ১৩টি, মদনে ৬টি, আটপাড়ায় ২টি, বারহাট্টায় ১টি ও কলমাকান্দায় ১০টি পিআইসি রয়েছে। গঠিত পিআইসির মধ্যে শুধু খালিয়াজুরির চাকুয়ার পাতরা বাঁধ (দুটি), মদনের ত্রিয়োশ্রী, মোহনগঞ্জের হাইজদা বাঁধ ও কলমাকান্দায় বড়খাপন এলাকায় বাঁধের সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে। বাকিগুলো এখনো আরম্ভ হয়নি। বাঁধগুলো মেরামতে এ বছর পাউবো প্রথম পর্যায়ে ৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। এদিকে সব কটি কমিটি গঠিত না হওয়া এবং বাঁধের কাজ শুরু না হওয়ায় স্থানীয় কৃষকেরা উদ্বিগ্ন।

জেলা হাওর উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি স্বাগত সরকার বলেন, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণেই এখনো সব পিআইসি গঠনের কাজ শেষ হয়নি। আর যেসব পিআইসি গঠিত হয়েছে, সেগুলোর কাজ এখনো শুরু হয়নি। স্বচ্ছতার মাধ্যমে পিআইসি গঠন করে দ্রুত বাঁধের কাজ শুরু করতে হবে। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা লাভবান হওয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়ে থাকেন। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এ ছাড়া বারবার একই ব্যক্তি যাতে পিআইসিতে না থাকেন, সে বিষয়েও নজর রাখতে হবে।

খালিয়াজুরির বোয়ালী গ্রামের আবদুল মোনায়েম, কৃষ্ণপুরের মুজিবুর রহমান, কুড়িহাটির মনির হোসেন, কৃষ্টপুরের পরিতোষ সরকার, মোহনগঞ্জের গাগলাজুর এলাকার কাজল চৌধুরী, মদনের বোয়ালী এলাকার আবদুর রহিমসহ কয়েকজন কৃষক জানান, এখনো পিআইসি গঠিত না হওয়ায় তাঁরা চিন্তিত। বাঁধের কাজ দ্রুত শুরু করে দেওয়া প্রয়োজন। নয়তো আগাম বন্যা হলে বোরো ফসল হুমকির মুখে পড়বে। আর দেরিতে তড়িঘড়ি করে কাজ করলে, তা টেকসই হয় না।

এ ব্যাপারে জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত আজ বিকেলে জানান, জেলায় ১২০টি পিআইসি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চূড়ান্ত ৮২টি কমিটি থেকে ৫টির কাজ শুরু হয়েছে। অন্যগুলো কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে। এ ছাড়া এই সপ্তাহের মধ্যে সব কটি পিআইসি গঠনের কাজ শেষ হবে।

খালিয়াজুরি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম, কলমাকান্দার ইউএনও মো. সোহেল রানা, মোহনগঞ্জের ইউএনও আরিফুজ্জামান ও মদনের ইউএনও বুলবুল আহমেদ জানান, এবার পানি একটু দেরিতে কমায় জরিপ ও পিআইসি গঠনকাজে বিলম্ব হয়েছে। দ্রুত কাজ আরম্ভ করে ভেকু মেশিনের সাহায্যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা সম্ভব হবে বলে তাঁরা আশা করছেন।