গম চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা

শ্রমিক না পাওয়ায় গম কাটছে একদল শিশু। তের মাইলের মাঠ, তারাগঞ্জ, রংপুর, ১৩ মার্চ
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় চাষিদের আবাদের তালিকা থেকে গম চাষ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। লাভ কম, শ্রমিকসংকট, বৈরী আবহাওয়া ও ভালো মানের বীজের অভাবে কেউ গম চাষে ঝুঁকি নিচ্ছেন না। চাষিরা গমের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষে ঝুঁকছেন।

ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মমতাজ উদ্দিন (৫০) বলেন, ‘বাবা, গম আবাদ বাদ না দিয়া করমো কী? এ্যালা তো গমের ফলন ভালো হয় না। কাটা মাড়াইয়েরও মানুষ পাওয়া যায় না। গম তুলি জমিত ধান গাড়লেও ভালো হয় না। ওই জন্যে মুই গমের আবাদ বাদ দিয়া ৫ হাজার টাকা খরচ করি ৬০ শতক জমিত মিষ্টিকুমড়া চাষ করছুন। এ পর্যন্ত কুমড়া বেচাছুন ১৯ হাজার টাকা। খেত এ্যাল যে কুমড়া আছে, আল্লাহর রহমতে তাকও বেচা হইবে ১৫-২০ হাজার টাকা।’

বামনদীঘি গ্রামের আরেক চাষি রেজাউল করিম (৪০) বলেন, ‘মুইও গমের আবাদ বাদ দিয়া এবার আলু নাগাছুন। গতবার ৫ হাজার ২০০ টাকা খরচ করি একদোন (২৪ শতক) জমিত গম নাগাছনু। গম পাছুন ৮ মণ। তাক ২৫ টাকা কেজি দরে বেচাছুন ৮ হাজার টাকা। খরচ বাদে লাভ হইছে ২ হাজার ৮০০ টাকা। ওই জন্যে এবার ওই জমিত গম না লাগে ১৫ হাজার টাকা খরচ করি লাল জাতের আলু নাগাছনু। আলু পাছুন ২ হাজার ২০০ কেজি। তাক ভূঁইয়োতে ১১ টাকা কেজি দরে বেচাছুন ২৪ হাজার ২০০ টাকা। খরচ বাদে লাভ হইছে ৯ হাজার ২০০ টাকা।’

উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এখানে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৯ হাজার ৯৬৫ হেক্টর। এর মধ্যে গম চাষের উপযোগী জমি প্রায় ৩ হাজার হেক্টর। কিন্তু ২০১৪ সালে ৩৩২ হেক্টর, ২০১৫ সালে ৩২০ হেক্টর, ২০১৬ সালে ৩১২ হেক্টর, ২০১৭ সালে ২৯৫ হেক্টর, ২০১৮ সালে ২৮৫ হেক্টর, ২০১৯ সালে ২৯০ হেক্টর, ২০২০ সালে ২৯৫ হেক্টর, ২০২১ সালে ২৯৯ হেক্টর জমিতে গম চাষ করা হয়েছে।

কৃষক ও কৃষি বিভাগ বলছে, শ্রমিকসংকট, ইঁদুরের উপদ্রব, মাড়াইয়ের সমস্যা, ভালো বীজের অভাব ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে গম চাষে চাষিরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। গমের পরিবর্তে তাঁরা অন্য ফসল চাষে ঝুঁকছেন।

তের মাইলের মাঠে গম কাটছেন পশ্চিম ইকরচালী গ্রামের মজিবর রহমান। তিনি বলেন, ‘মোর ৫০ শতক জমির বোরো ধান বানে খাছলো। বাজার থাকি গমের বীজ আনি নাগাছনু। শিষগুলা ছোট ছোট হইছে। মানুষ আবানে তাক ঘরোত তুলার পাওছুন না। নিজের গম নিজে কাটুছুন।’

জগদীশপুর গ্রামের চাষি আতিয়ার রহমান বলেন, ‘গম কাটা কাম তো কায়ও করিবার চায় না। বাজারোত এ্যালা ভালো বীজও পাওয়া যায় না। মুই ৪০ শতক জমিত গম লাগাছুং। গম কাটার কিষান না পাওয়ায় ছোট ছোট ছাওয়াগুলাক গম কাটার নাগে দিছুন।’

সয়ার গ্রামের চাষি একরামুল হক প্রতিবছর সংসারের চাহিদা মেটানোর জন্য গম চাষ করেন। এবারেও তিনি ১০ শতকে গমের চাষ করেছেন। বাণিজ্যিকভাবে গম চাষ করেন না কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গম চাষোত তো লাভ কম। ওই তকনে মোর ৫০ শতক জমিত ফুলকপি লাগাছনু। তাক বেঁচে ২৫ হাজার টাকা লাভ করছুন। খাটুনি কম, গমের চেয়া লাভও বেশি।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উর্মি তাবাসসুম বলেন, ‘কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা চাষিদের গম চাষের জন্য সব সময় উৎসাহিত করে যাচ্ছি। চাষিদের গম বীজ, সার দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মাড়াইয়ের সমস্যা, ইঁদুরের উপদ্রব, গমের চেয়ে অন্য ফসলে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকেরা গম চাষ থেকে সরে আসছেন।’