‘গরিবের হাসপাতালে’ স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে সহস্রতম শিশুর জন্ম

নবজাতককে নিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরছেন প্রসূতি খাদিজা আক্তার। পাশে ক্লিনিকের প্রসবকর্মী লিপা খানম। আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকে।
ছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় ‘গরিবের হাসপাতাল’ হিসেবে পরিচিত ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিক সহস্রতম স্বাভাবিক প্রসবের রেকর্ড গড়েছে। গ্রামের ভেতরের ছোট্ট এই কমিউনিটি ক্লিনিকে ৯ বছর ধরে বিনা খরচে স্বাভাবিক প্রসব কার্যক্রম চলছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, স্বাভাবিক প্রসবে সিলেট বিভাগে ক্লিনিকটি প্রথম স্থানে রয়েছে।

পার্শ্ববর্তী বড়লেখা উপজেলার খাদিজা আক্তারের (২৫) বিয়ে হয়েছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় কয়েক মাস আগে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। প্রসবব্যথা ওঠায় আজ মঙ্গলবার সকাল সাতটার দিকে স্বজনেরা তাঁকে ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকে নিয়ে আসেন। ক্লিনিকের বেসরকারি প্রসবকর্মী (প্রাইভেট সিএসবিএ) লিপা খানমের সহায়তায় ৯টা ২০ মিনিটে খাদিজার একটি ফুটফুটে ছেলেসন্তান জন্ম নেয়। এটি তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। এর মাধ্যমে ক্লিনিকে সহস্রতম স্বাভাবিক প্রসবের রেকর্ড হয়।

কমিউনিটি ক্লিনিকটিতে এক হাজার জন নারীর স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। এর মধ্যে সাতজন নারী যমজ সন্তান প্রসব করেছেন। সেই হিসাবে মোট জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা এক হাজার ৭ জন।

সদর জায়ফরনগর ইউনিয়নের ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকে সকাল ১০টার দিকে দেখা যায়, খাদিজা ও তাঁর স্বজনদের খুশির শেষ নেই। সহস্রতম স্বাভাবিক প্রসবের খবর পেয়ে ছুটে যান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সমরজিৎ সিংহ, চিকিৎসা কর্মকর্তা শহিদুল আমিন ও ক্লিনিক পরিচালনা কমিটির কয়েক সদস্য। সেখানে প্রসূতির স্বজনদের পক্ষ থেকে তাঁদের মিষ্টিমুখ করানো হয়।

খাদিজার বড় বোন আছমা আক্তার বলেন, ‘কয়েক দিন আগে রোগীরে (প্রসূতি) নিয়া আইয়া দেখাইছি। লিপা আপায় (প্রসবকর্মী) প্রেশারসহ (রক্তচাপ) কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। বলছেন, ব্যথা উঠলে দ্রুত নিয়া আসতে। সুন্দরভাবে ডেলিভারি (প্রসব) হইছে। আমরা খুব খুশি। মা ও বাচ্চা সুস্থ আছে।’ আছমা আক্তার আরও বলেন, ‘প্রাইভেট হাসপাতালে গেলে তো অনেক টাকাপয়সা লাগত। আমরার মতো মানুষের লাগি এই খরচ কুলানো তো সম্ভব নয়।’

প্রসবকর্মী লিপা খানমের বাড়িও ভোগতেরা গ্রামে। তিনি বলেন, প্রসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৪ সালের জুনে তিনি এ ক্লিনিকে যোগ দেন। তাঁর হাতে এ পর্যন্ত ৭৪৮ শিশুর প্রসব হয়েছে। তবে এ কাজের বিনিময়ে তিনি কোনো পারিশ্রমিক পান না।

ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবাকর্মী (সিএইচসিপি) হানিফুল ইসলাম জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। স্থানীয় বাসিন্দা মইনুল ইসলাম ক্লিনিকের জমি দান করেন। ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি সেখানে প্রথম স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে শিশুর জন্ম হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে সেই সংখ্যা বাড়তে থাকে। শুধু জুড়ী নয়, আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকেও এখানে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা নারীরা সেবা নিতে আসেন। ক্লিনিকে জন্ম নেওয়া সহস্র শিশুর মধ্যে ৫৪০ জন মেয়ে ও ৪৬৭ জন ছেলে। এর মধ্যে যমজ আছে সাতজন।

কমিউনিটি ক্লিনিকটির কার্যক্রম নিয়ে ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ প্রথম আলোয় ‘গরিবের হাসপাতাল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।

হানিফুল জানান, নিরাপদ স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৯ জুন নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের অনুষ্ঠানে ওই ক্লিনিককে পুরস্কৃত করেন। একই বছরের ১৬ জুলাই জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ’ কমিউনিটি ক্লিনিক হিসেবে এ ক্লিনিক পুরস্কার পায়। এ ছাড়া প্রসূতিসেবায় অবদানের জন্য ২০১৮ সালে মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন এবং ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটি পুরস্কার পায়।

ক্লিনিক পরিচালনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ রফিক মিয়া, সদস্য মোস্তাকীন আহমদ ও জহির উদ্দিন বলেন, ২০১৩ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত মুজিবুর রহমান ফকির ক্লিনিকটি পরিদর্শনে আসেন। তিনি এ ক্লিনিককে ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতাল করার আশ্বাস দেন। পরে আর এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাঁরা প্রতিমন্ত্রীর সেই আশ্বাস বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সমরজিৎ সিংহ বলেন, স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকের সুনাম দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। সিলেট বিভাগের সব কমিউিনিটি ক্লিনিকের মধ্যে এটির স্থান প্রথম। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এ সুনাম ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসব কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।