গাইবান্ধায় বন্ধুসভার ঈদ উপহার

গাইবান্ধা প্রথম আলো বন্ধুসভার উদ্যোগে দুস্থদের মধ্যে ঈদ উপহারসামগ্রী বিতরণ করা হয়। গাইবান্ধা আসাদুজ্জামান গার্লস স্কুল ও কলেজ মাঠ, ৯ মে
ছবি: প্রথম আলো

গাইবান্ধায় প্রথম আলো বন্ধুসভার ঈদ উপহার বিতরণের সময় দেওয়া হয়েছিল বেলা দুইটায়। কিন্তু সকাল ১০টা থেকে গাইবান্ধা আসাদুজ্জামান গার্লস স্কুল ও কলেজ মাঠে অপেক্ষা করছিলেন সকিনা বেগম (৫৫)। তাঁর মুখেচোখে হতাশার ছাপ। হাতে ত্রাণ বিতরণের টোকেন।

এত আগে এসেছেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সকিনা বললেন, ‘এ ব্যারকা ওজাত কাউয়ো ইলিপ দ্যায় নাই। কয়দিন পর ঈদ। ঈদোত ছোলগুলেক কী খাওয়ামো। তাই আগেভাগে আচ্চি। পরে যদি না পাওয়া যায়।’ এরপর তাঁর হাতে বন্ধুসভার ঈদ উপহারসামগ্রী তুলে দেওয়া হয়। উপহার হাতে পেয়ে চোখের জলে যেন উপহারের প্যাকেট ভিজে যাচ্ছিল।

সকিনাকে স্বাভাবিক করে তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের টেংগরজানি গ্রামে তাঁর বাড়ি। আট বছর আগে দিনমজুর স্বামী মন্টু মিয়া মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে শীলা বেগমের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু গত বছর সড়ক দুঘর্টনায় জামাই মারা যান। তখন থেকে মায়ের সংসারে বসবাস। একমাত্র ছেলে সাকিব। সে একটি বেসরকারি কারিগরি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙে যাওয়ায় সাকিবও এখন পঙ্গু। বিধবা সকিনার দুই ছেলেমেয়ে ও এক নাতিকে (৭) নিয়ে চার সদস্যের সংসার।

সকিনা বললেন, ‘চেরমেন মেম্বররা হামাক বিধবা ভাতার কাড দ্যায় নাই। ভিজিডি কাডও পাই নাই। এ বাড়িত–ও বাড়িত কাম করি। যা পাই, তাক দিয়া কোনো দিন এক ব্যালা কোনো দিন দুই ব্যালা খায়া থাকি। তার ওপর ব্যাটার নেকাপড়ার খরোচ। কদিন পর ঈদ। ঈদোত নয়া জামা নেওয়ার জন্নে নাতিট্যা বায়না ধরচে। ঈদোত খাবার বুদ্দি আচিল না, জামা কোনটে থাকি কিনমো। আল্লায় তোমার ঘরে ভালো করুক বাবা। আচকে তোমার ঘরে পোত্তম আলোর চাউল, ডাল, তেল, লবণ দিলেন। তাক ঈদের দিন খামো। তারপর হামরা ঘরে কি খামো চিনতাত আচি।’

সকিনার মতো গাইবান্ধা শহর ও সদর উপজেলার ১১০ জন নারী-পুরুষকে রোববার দুপুরে ঈদ উপহারসামগ্রী দেয় গাইবান্ধা প্রথম আলো বন্ধুসভা। বন্ধুসভার সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচির আওতায় এসব সামগ্রী দেওয়া হয়। ঈদ উপহার হিসেবে প্রত্যেককে চার কেজি চাল, এক কেজি লবণ, এক লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি আলু, একটি করে মাস্ক এবং এক কেজি মসুরের ডাল দেওয়া হয়। বেলা দুইটায় ঈদ উপহার বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবদুর রাফিউল আলম।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এসব সামগ্রী দুস্থদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। উপহারসামগ্রী বিতরণ পূর্ববর্তী এক সভায় বক্তব্য দেন গাইবান্ধা আসাদুজ্জামান গার্লস স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ ইদ্রিশ আলী, সাংবাদিক ইদ্রিসুজ্জামান, কুদ্দুস আলম ও শাহজাহান সিরাজ, প্রথম আলোর প্রতিনিধি শাহাবুল শাহীন প্রমুখ।

উপস্থিত ছিলেন গাইবান্ধা প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি মেহেদী হাসান সরকার, সহসভাপতি ওবায়দুল ইসলাম ও রাসেল সরকার, সাধারণ সম্পাদক মিল্লাত হোসাইন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লিমন প্রধান ও ইমরান মাসুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান, দপ্তর সম্পাদক রেজাউল ইসলাম, বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক আসিফ আকন্দ, পাঠচক্র সম্পাদক অন্তর কুমার, সদস্য রিপন আকন্দ ও আবু সাঈদ প্রমুখ।

ঈদ উপহার পেয়ে গাইবান্ধা শহরের সুখনগর এলাকার জবা খাতুন (৩৫) বলেন, ‘এ্যাকনা ইলিপের জন্নে চেরমেনের বাড়িত গেচিনো, হামাক ইলিপ দ্যায় নাই। আচকে তোমার ঘরে আলোর চাউল পায়া উপোক্যার হলো বাবা। ঈদোত প্যাট ভরে খাবার পামো।’

সদর উপজেলার চাপাদহ গ্রামের শাহজাহান প্রামাণিক (৪৫) নিজের ভাষায় বললেন, ‘করোনাত কসটো করব্যার নাগচি। বাইরে বারান যায় না। দিনে যেকনা কামাই করি, তাক দিনেই চলি যায়। ঈদোত খামো কি। তার বুদ্দি আচিলো না। তোমার ঘরে পোত্তম আলোর ইলিপকোনা পায়া উপক্যার হলো।’

উপহার পেয়ে একই গ্রামের দিনমজুর মনজিল মিয়া (৫০) বললেন, ‘করোনার মৃদ্দে কাম আচিলো না। দ্যানা করি খাচি। একন কাম করি দ্যানা শোদ দিব্যার নাগচি। কিনতো ঈদোত তিনটে ছোলোক পোসাক কিনি দেমো নাকি বাজার করমো তাক নিয়া চিনতাত আচি। চেয়ারম্যানের কাচে গেলে তাই কয় কোথায় থাকি ইলিপ দেবো। আচ পোত্তম আলো পেপারের চাউল–ডাল পায়া ভালো নাগচে। আইতে পেট ভরে ভাত খেতে পারমো।’

খোলাহাটি গ্রামের কেজি স্কুলের শিক্ষক ময়নুল হক (৫০) বলেন, ‘সরকার আমাদের বেতন-ভাতা দেয় না। আমরা শিক্ষার্থীদের বেতনে চলি। কিন্তু প্রায় দেড় বছর ধরে কেজি স্কুলগুলো বন্ধ রয়েছে। আমাদের বেতন-ভাতাও বন্ধ। ধারদেনা করে চলছি। খুব বিপদে আছি। আজ প্রথম আলোর ঈদ উপহার পেয়ে ভালো লাগছে। উপহার সামান্য হলেও অনেকটা উপকার হবে।’

ইউএনও রাফিউল আলম বলেন, প্রথম আলোর ত্রাণ বিতরণের এই উদ্যোগ অনেক প্রশংসার। করোনা বিপর্যয়ে মানুষ বিপাকে পড়েছেন। এই সংকটের সময় প্রথম আলো তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকাটি সব সময় অসহায় মানুষের পাশে থাকে, এটা ভালো উদ্যোগ। সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলুন। সবাই মাস্ক ব্যবহার করুন। কোনো শিশুকে বাল্যবিবাহ দেবেন না।

গাইবান্ধা আসাদুজ্জামান গার্লস স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ ইদ্রিশ আলী বলেন, পত্রিকার কাজ সংবাদ প্রচার করা। কিন্তু প্রথম আলো ব্যতিক্রম। পত্রিকাটি মানবিক মূল্যবোধ থেকে যে ঈদ উপহার বিতরণ করছে, তা মহৎ উদ্যোগ। এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকুক।