গাজীপুরে যাত্রাপথে অসতর্কতা, প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা–ছিনতাই

ফেরিওয়ালা, সাধারণ যাত্রী বা ভবঘুরে সেজে অবস্থান করে প্রতারক চক্র। যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়লে বা একটু অসতর্ক হলেই তারা শুরু করে ছিনতাই।

ট্রেনের জানালার পাশে বসে কেউ ঘুমিয়ে পড়েছেন, কেউবা মাথা বাইরে রেখেছেন। এতে ঘটছে দুর্ঘটনা। সম্প্রতি গাজীপুরের ধীরাশ্রম রেলস্টেশনে।
ছবি: প্রথম আলো

কোথাও ভ্রমণ, বাড়িফেরা বা কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত—প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণপরিবহনে উঠতে হয় সাধারণ মানুষের। তাঁরা কখনো বাস, কখনো ট্রেন, কখনোবা লঞ্চে যাতায়াত করেন। কিন্তু যাত্রার সময় অনেকেই থাকেন অসতর্ক। কেউ আসনে বসে ঘুমান, কেউ জানালা দিয়ে হাত বা মাথা বের করে রাখেন, আবার কেউ মুঠোফোনে অসতর্কভাবে কথা বলেন। এতে বিভিন্ন সময় নানা দুর্ঘটনা, মালামাল খোয়া যাওয়াসহ ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনাও।

গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যা। ‘তুরাগ এক্সপ্রেস’ ট্রেনে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আরিফুল হক। তিনি ছিলেন ট্রেনটির জানালার পাশের আসনে। একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। খানিক পর ঘুম ভাঙতেই দেখেন তাঁর সঙ্গে থাকা ব্যাগটি নেই।

একইভাবে ৬ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলেন রাকিবুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। রাত ১০টার দিকে ট্রেনটি থামে টঙ্গী রেল জংশনে। রাকিবুল তখন ট্রেনটির জানালার পাশের আসনে বসে মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। হঠাৎ এক ছিনতাইকারী তাঁর মুঠোফোন নিয়ে দৌড় দেয়। পরে রাকিবুল ওই ছিনতাইকারীর পেছনে ছুটতে গিয়ে খুন হন। এর মাস দেড়েক আগে বাসে আসনের পাশে ব্যাগ রেখে মুঠোফোনে কথা বলায় ব্যস্ত ছিলেন জাহানারা হায়দার নামের এক কর্মজীবী নারী। তিনি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সাতাইশ এলাকায় পৌঁছে দেখেন তাঁর পাশে রাখা ব্যাগ নেই।

শুধু ছিনতাই বা মালামাল খোয়া যাওয়ার ঘটনা নয়, যাত্রাপথে ঘুম বা একটু অসতর্কতায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। বিশেষ করে বাসের জানালা দিয়ে অসতর্কতাবশত হাত বা মাথা বের করে রাখলে দুই বাসের সংঘর্ষে হাত বা মাথা থেঁতলে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া অসতর্কতার কারণে অনেকেই অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন।

গত আট মাসে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কথা হয় ঘটনার শিকার আরিফুল, জাহানারা হায়দার ও রাকিবুলের এক সহকর্মীর সঙ্গে। আরিফুলের ভাষ্য, ‘ট্রেনটি কিছু সময়ের জন্য (সিগন্যালে) টঙ্গীর বনমালা রেলক্রসিং এলাকায় থামে। তখন চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ক্লান্ত শরীর থাকায় হালকা ঝিমুনি দিয়ে ঘুম আসে। মিনিট দুই বা তিনেক পর ঘুম ভাঙতেই দেখি ব্যাগ নেই।’

জাহানারা বলেন, ‘বাসে ওঠার পর থেকেই কয়েকজন তরুণ আমার পাশে ঘিঞ্জি আকারে দাঁড়িয়ে ভিড় করছিল। আমি আমার ব্যাগটি আসনের পাশে রেখে একজনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিলাম। কথা শেষে দেখি ব্যাগ নেই। ওই সব তরুণও হঠাৎ উধাও।’

সাধারণত বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাটসহ কোলাহলপূর্ণ এলাকায় আগে থেকেই ওত পেতে থাকে একধরনের প্রতারক চক্র। ফেরিওয়ালা সেজে মালামাল বিক্রির ছলে, সাধারণ যাত্রী সেজে বা কখনো ভবঘুরে হয়ে অবস্থান করে এসব কোলাহলপূর্ণ জায়গায়। কোনো কারণে যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়লে বা অন্যমনস্ক হলে বা অন্য কোনোভাবে সুযোগ পেলে যাত্রীদের সবকিছু হাতিয়ে নেন তারা। অনেক সময় ট্রেন বা বাসের জানালা দিয়ে যাত্রীদের মালামাল, স্বর্ণালংকার নিয়ে টান দিতে গিয়েও ঘটে দুর্ঘটনা।

সাধারণত যাঁরা এসব প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েন বা দুর্ঘটনার শিকার হন, তাঁরা বেশির ভাগই দূরদূরান্তের যাত্রী। ঝামেলার ভয়ে বা সময় না থাকায় তাঁদের অধিকাংশই পুলিশের কাছে খুব একটা অভিযোগ করেন না। এ ছাড়া থানায়ও এসব ঘটনায় আসামি ধরার খুব একটা খবর পাওয়া যায় না। তবে সংশ্লিষ্ট বাস বা রেলস্টেশনগুলোতে প্রায়ই এ ধরনের অভিযোগ আসে বলে জানা যায়।

এসব বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই। এ ছাড়া যেকোনো স্টপেজ বা কোলাহলপূর্ণ জায়গাগুলোতে প্রচারপত্র বিলি, হ্যান্ডমাইকে ঘোষণাসহ বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা হয়। প্রায়ই অভিযান চালিয়ে এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়।
মো. আজাদ মিয়া, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, গাজীপুর মহানগর

সম্প্রতি কথা হলে জয়দেবপুর রেল জংশনের স্টেশনমাস্টার মো. শাজাহান বলেন, ‘যাত্রাপথে কোনো কিছু খোয়া গেলে বা দুর্ঘটনার শিকার হলে যাত্রীরা প্রায়ই আমাদের কাছে আসেন। আমরা বিষয়গুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাই।’

এদিকে যাত্রাপথে সুরক্ষা বা সতর্কতা নিয়ে বিভিন্ন সময় কাজ করে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর মধ্যে গাজীপুর-ঢাকা ট্রেন প্যাসেঞ্জার ফোরাম নামের একটি সংগঠনের নেতৃত্বদানকারীদের একজন মো. ফানতাহিল আলিম বলেন, ‘আমরা সব সময়ই যাত্রাপথে ঘুমিয়ে না পড়া, জানালা দিয়ে হাত বা মাথা বের না করা, ছাদে না চড়া, কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্টে বাস বা ট্রেনের জানালা বন্ধ রাখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে যাত্রীদের সতর্ক করি।’

এ বিষয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আজাদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই। এ ছাড়া যেকোনো স্টপেজ বা কোলাহলপূর্ণ জায়গাগুলোয় প্রচারপত্র বিলি, হ্যান্ডমাইকে ঘোষণাসহ বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা হয়। প্রায়ই অভিযান চালিয়ে এসব অপকর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়।’