গাড়ির আশায় আবদুল্লাহপুর, টঙ্গীতে ভিড় করছে মানুষ

দূরপাল্লার বাসের আশায় রাজধানীর আবদুল্লাহপুর মোড়ে জড়ো হয়েছেন ঘরমুখী হাজারো মানুষ। দীর্ঘ অপেক্ষার একপর্যায়ে হেঁটেই রওনা দিচ্ছেন কেউ কেউ। আজ সোমবার বেলা দুইটায়
ছবি: প্রথম আলো

খোরশেদ আলম চাকরি করেন রাজধানীর মতিঝিল এলাকার একটি বেসরকার প্রতিষ্ঠানে। গ্রামের বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে। মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি জামালপুরের বাস ধরে গ্রামের বাড়ি যান তিনি। ভাড়া লাগে ৩০০–৩৫০ টাকা। পরিবার নিয়ে এভাবেই ১০ বছর ধরে আসা–যাওয়া করছেন।

এবারও ঈদে বাড়ি যেতে তিন বছরের শিশু রাবেকা ও স্ত্রী খোদেজা বেগমকে নিয়ে সোমবার সকালে বের হন বাসা থেকে। সিএনজিতে করে প্রথমে আসেন মহাখালী। আশা ছিল, বাস না পাওয়া যাক, অন্তত প্রাইভেট কার বা অন্য কোনোভাবে যাওয়া যাবে বাড়ি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হলো না। স্থানীয় লোকজনের পরামর্শে আরেকটি সিএনজিতে করে আসেন আবদুল্লাহপুর মোড়ে।


খোরশেদ আলমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, ঘড়িতে তখন বেলা দুইটা। মাথার ওপর তপ্ত রোদ। বাসের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লান্তি ধরেছে তাঁর স্ত্রী–সন্তানেরও। তাঁরা বসেছিলেন রাস্তার পাশের একটি চায়ের দোকানের বেঞ্চে। খোরশেদ আলম বলেন, ‘ভাই, মতিঝিল থেইকা এই পর্যন্ত আইতে কী যে কষ্ট হইছে তা আর বলার মতো না! স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কোথাও কোথাও দ্বিগুণ তিন গুণ ভাড়া দিয়ে আসছি। ভাবছিলাম এখান থেকে অন্তত সরাসরি জামালপুরের গাড়ি পাওন যাইব। কিন্তু এখানে তা হলো না।’

খোরশেদ আলমের মতো এমন হাজারো ঘরমুখী মানুষের ভিড় দেখা যায় রাজাধানীর আবদুল্লাহপুর মোড়ে। কারও হাতে বড় বড় গাট্টি বোঁচকা, কারও বা ব্যাগ। তাঁরা সবাই থাকেন রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকায়। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে গ্রামের বাড়ি ছুটছেন তাঁরা। আবদুল্লাহপুর থেকে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যাবে, এমন আশায় জড়ো হয়েছেন তাঁরা। কিন্তু সরকারি বিধিনিষেধ থাকায় দূরপাল্লার গণপরিবহন চলছে না এখান থেকে। তাই এই যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা দেখা যায়। এর মধ্যে কেউ কেউ হেঁটেই রওনা দিয়েছেন গন্তব্যে। আজ সোমবার সকাল সাড়ে দশটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত আবদুল্লাহপুর ও তার আশপাশের এলাকায় ঘুরে দেখা যায় এ চিত্র।

সকালের দিকে খুব একটা চাপ না থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরমুখী মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে
ছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় গিয়েও বিপুলসংখ্যক ঘরমুখী মানুষের ভিড় দেখা যায়। টঙ্গী-ঘোড়াশাল আঞ্চলিক সড়কের শুরুতেই নরসিংদী ও আশপাশের এলাকায় যাত্রী পরিবহনের জন্য অপেক্ষা করছিল সিএনজি ও মাইক্রোবাস। এর মধ্যে কোনো যাত্রী আসতে দেখলেই ডেকে নিচ্ছিলেন তাঁরা। যাত্রীরা দরদাম বা ভাড়া ঠিক করে যাচ্ছিলেন নিজ নিজ গৌন্তব্যে।

এতো ঝক্কিঝামেলা করে বাড়ি যাওয়ার দরকার কী? এমন প্রশ্নে খোরশেদ আলম বলেন, ‘ভাই, বছরে একটা ঈদ, বাড়িতে বুড়া মা-বাবা আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। তা ছাড়া ঢাকায়ও আমাদের তেমন কোনো আত্মীয় নাই যে সবাই মিলে ঈদ করব। তাই কষ্ট যেনেও বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিছি।’

এসব বিধিনিষিধ মানুষের ভোগান্তি ছাড়া আর কিছুই না। হয় লকডাউন দিলে ভালো কইরা দিব, না হলে না। আমাদের পেটের দায়ে প্রতিদিনই ঘর থেকে বের হতে হয়।
নুরুল হক, ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী যাত্রী

আবদুল্লাহপুরে অপেক্ষারত যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঘরমুখী মানুষ সিএনজি, রিকশা, অটোরিকশা, বাস (শুধু রাজধানীতে চলে) বা বিভিন্ন মাধ্যমে এসেছেন আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত। কিন্তু দূরপাল্লার কোনো বাস আবদুল্লাহপুর মোড় থেকে ছেড়ে যায়নি। তাই বেকায়দায় পড়েছেন প্রায় সবাই। তবে মাঝেমধ্যে মাইক্রোবাস, সিএনজি, মোটরসাইকেলে করে যাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাইরে কোনো জেলায়। কিন্তু আকাশচুম্বী ভাড়ায় এসব মাধ্যমে যাওয়ারও সাহস করছেন না অনেকে। তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহননের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা। এর মধ্যে কেউ কেউ বাধ্য হয়েই গৌন্তব্যে যাচ্ছিলেন এসব যানবাহনে চড়ে।

বেলা ১টা ৩০ মিনিটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় যেতে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে নুরুল হককে (৫৫)। তিনি সাভার এলাকা থেকে দ্বিগুণ ভাড়া খরচ করে এসেছেন আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত। এরপর দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে একটি সিএনজিতে আরও চারজনের সঙ্গে নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা দেন। এরপর নরসিংদী থেকে পুনরায় অন্য কোনো যানে চড়ে যাবেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। যাওয়ার আগে প্রচণ্ড ক্ষোভ ঝেড়ে তিনি বলেন, ‘এসব বিধিনিষিধ মানুষের ভোগান্তি ছাড়া আর কিছুই না। হয় লকডাউন দিলে ভালো কইরা দিব, না হলে না। আমাদের পেটের দায়ে প্রতিদিনই ঘর থেকে বের হতে হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়। এসব নিয়মকানুন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য ভোগান্তি ছাড়া আর কিছুই না।’

মাঝেমধ্যে মাইক্রোবাস, সিএনজি, মোটরসাইকেলে করে যাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাইরে কোনো জেলায়। কিন্তু আকাশচুম্বী ভাড়ায় এসব মাধ্যমে যাওয়ারও সাহস করছেন না অনেকে
ছবি: প্রথম আলো

একটি মোটরসাইকেলে করে নরসিংদীর পাঁচদোনার উদ্দেশে রওনা দিচ্ছিলেন মো. মাসুদ ও সোহেল নামের দুই ভাই। ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা। তাঁরা রাজধানীর আশকোনা এলাকার একটি মেসে থাকেন। যাওয়ার আগে তাঁরা বলেন, ইতিমধ্যে মেসের রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই বাড়ি চলে গেছে। তাঁরা চাইলেও আর ঢাকায় থাকতে পারবেন না। তাই কষ্ট জেনেও বাড়িতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

এদিকে সকালের দিকে খুব একটা চাপ না থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরমুখী মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। দুপুর ১২টার পর থেকেই যান ও মানুষের আনাগোনা বাড়তে দেখা যায়। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকা পার হয়ে গাজীপুর ঢুকছে, এমন কোনো গাড়ি দেখলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন সবাই। গাদাগাদি করে বা চাপাচাপি করে উঠে পড়েন এসব বাসে। এর মধ্যেই কোনো কোনো বাসকে গাজীপুরে প্রবেশ করতে বাধা দেয় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ।

সকাল থেকেই সড়কে ডিউটি করছিলেন আবদুল্লাহপুর পুলিশ বক্সের ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) সাজ্জাদ হোসেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকাল থেকে মানুষের খুব একটা চাপ ছিল না। এখন মানুষ বাড়ছে। অনেকে হেঁটেই যাচ্ছেন। তাঁরা ঢাকার গাড়িগুলো ঢাকার মধ্যেই রাখছেন। কোনো বাস ঢাকার বাইরে যেতে চাইলে থামিয়ে দিচ্ছেন। তা ছাড়া কোনো মাইক্রোবাস বা অন্যান্য যানবাহন ঢাকার বাইরে যেতে দেখলে রেকারে দিচ্ছেন।