গাড়ির জন্য ছুটছে কিশোর ছেলে, সড়কে বসে অসুস্থ মায়ের কান্না

বাড়ি ফেরার গাড়ির জন্য দুই ঘণ্টা ধরে ছেলের ছোটাছুটি দেখতে দেখতে কাঁদতে শুরু করেন অসুস্থ আমেনা বেগম। আজ বুধবার বেলা ১১টায় ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১১টা। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে মদনপুর মোড় পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারজুড়ে হাজারো ঘরমুখী মানুষের ভিড়। সড়কে পরিবহন–সংকট। এরই মধ্যে চলাচল করা বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান দেখলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ। ধাক্কাধাক্কি করে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে কোনো রকমে জায়গা করে নিচ্ছে পরিবহনগুলোতে। যারা ভেতরে জায়গা পাচ্ছে না, তারা ঝুলে থেকে কোনো রকমে গন্তব্যে রওনা হচ্ছে।

এমন সময় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ শিমরাইল এলাকায় সড়কের পাশে ফেলে রাখা একটি বিদ্যুতের খুঁটিতে বসে কাঁদছিলেন আমেনা বেগম (৪৩)। তিনিও ঘরমুখী মানুষের একজন। তবে ঈদ উপলক্ষে বাড়ি ফিরছেন না, টাকার অভাবে হার্ট আর কিডনি রোগের চিকিৎসা শেষ না করেই হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে যাচ্ছেন চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে। সঙ্গে একমাত্র ছেলে জাহিদুল ইসলাম (১৭)।

সকাল ৯টা থেকে এদিক–সেদিক ছোটাছুটি করে মায়ের জন্য একটি পরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারেনি কিশোর জাহিদ। বৈশাখের উত্তাপ মাথায় অসুস্থ শরীর নিয়ে সড়কে বসে আছেন মা, ব্যস্ত সড়কে ছোটাছুটি করছে কিশোর ছেলে। মাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার একটা ব্যবস্থা যদি হয়।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে স্বাভাবিকের চেয়ে ছয় থেকে সাত গুণ ভাড়ায় ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাসে গন্তব্যে রওনা হয়েছে। কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে রওনা হয়েছে মালবাহী লরি ও কাভার্ড ভ্যানে।
বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান দেখলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ
ছবি: প্রথম আলো

আলাপে আমেনা বেগম জানান, এক মাস আগে একই সঙ্গে হার্ট ও কিডনিজনিত অসুস্থতা ধরা পড়েছে তাঁর। ধারদেনা করে প্রায় এক মাস রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করেছেন। টাকার অভাবে এখন আর চিকিৎসা করানোর অবস্থা নেই। হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। আজ বুধবার সকালে রাজধানীর হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে এসেছেন সাইনবোর্ড মোড়ে। সেখানে গাড়ি না পেয়ে শিমরাইল মোড়। এখানেও প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। গাড়ি মেলেনি। গাড়ির জন্য ছেলের এমন অসহায় ছোটাছুটি দেখেই কাঁদছেন আমেনা। নিজেদের ভাগ্যের দোষ দিচ্ছেন।

এরই মধ্যে মায়ের জন্য বোতলভর্তি ঠান্ডা পানি নিয়ে আসে জাহিদ। মায়ের চোখমুখে পানির ঝাপটা দেয়। আশ্বস্ত করে, ‘একটু বও মা, গাড়ি পামু।’ মাকে দেওয়া আশ্বাস হয়তো নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিল না জাহিদ। তার চোখমুখে তখনও ক্লান্তি আর হতাশার ছাপ।
জাহিদ বলে, দুই ঘণ্টায় চাঁদপুরের একটি বাসও পায়নি সে। চাঁদপুরের অনেক যাত্রীই ট্রাক–পিকআপে করে কুমিল্লা পর্যন্ত যাচ্ছেন। অসুস্থ মাকে নিয়ে সেগুলোতে ওঠা যায় না। কুমিল্লায় যাওয়া বাসগুলোতে ওঠার চেষ্টা করেছে। মানুষের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেননি মা। মাইক্রোবাসও পাচ্ছে না। এদিকে সদ্য হাসপাতাল থেকে আসা মা সড়কে বসে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

তিন ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে দুপুর সোয়া ১২টায় মাকে নিয়ে কুমিল্লাগামী একটি মাইক্রোবাসে চড়ে বসে জাহিদ। শিমরাইল মোড় থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের কুমিল্লা বিশ্বরোড পর্যন্ত জনপ্রতি তাদের ভাড়া গুনতে হবে ১ হাজার ২০০ টাকা।

ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে মদনপুর মোড় পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারজুড়ে হাজারো ঘরমুখী মানুষের ভিড়
ছবি: প্রথম আলো

বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জাহিদ ও আমেনার মতো হাজার হাজার মানুষের ভিড় দেখা গেছে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে স্বাভাবিকের চেয়ে ছয় থেকে সাত গুণ ভাড়ায় ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাসে গন্তব্যে রওনা হয়েছে। কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে রওনা হয়েছে মালবাহী লরি ও কাভার্ড ভ্যানে। জনপ্রতি দুই হাজার থেকে চার হাজার টাকা ভাড়ায় মোটরসাইকেলগুলোতে অনেকেই গন্তব্যে রওনা হয়েছে।

অন্যান্য দিনের তুলনায় বুধবার যাত্রীর চাপ বেশি ছিল। সে তুলনায় পরিবহন ছিল হাতেগোনা। চট্টগ্রাম ও সিলেট সড়কে চলা বাসগুলো এলাকা ভেদে জনপ্রতি ৬০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ এবং মাইক্রোবাসগুলো ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া নিয়েছে।

আগে এক গাড়িতেই বাড়ি যাওয়া যেত। এখন চার–পাঁচবার গাড়ি পাল্টাতে হবে। এতে বেশি মানুষের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে, করোনার ঝুঁকিও বাড়ছে।
আবুল ফজল, কুমিল্লার ভবের চরের বাসিন্দা

সোমবার এসব বাসে গন্তব্যে যেতে ১৫০ থেকে ৮০০ টাকা এবং মাইক্রোবাসগুলোতে ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়েছিল যাত্রীদের।

নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে রওনা হওয়া পোশাকশ্রমিক হাফিজুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় কাঁচপুর সেতুর পূর্ব পাশে। আপাতত জনপ্রতি ৬০০ টাকা ভাড়ায় একটি পিকআপ ভ্যানে দাঁড়িয়ে কুমিল্লার দাউদকান্দির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছেন। বাকি পথ কীভাবে যাবেন জানা নেই।

পিকআপে গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরছে মানুষ
ছবি: প্রথম আলো

দুই ছেলে আর স্ত্রীসহ ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছেন মুদি ব্যবসায়ী আলী হোসেন। আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে একটি পণ্যবাহী ট্রাকের পেছনে চড়ে বসেছেন। ভৈরব পর্যন্ত তাঁকে জনপ্রতি ৫৫০ টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে।

দুপুরে মদনপুর মোড়ে কথা হয় কুমিল্লার ভবের চরের বাসিন্দা আবুল ফজলের সঙ্গে। পরিবারের তিন সদস্য নিয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছেন। ঢাকা থেকে মদনপুর আসতেই তিনবার গাড়ি পাল্টেছেন তিনি। আবুল ফজল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে এক গাড়িতেই বাড়ি যাওয়া যেত। এখন চার–পাঁচবার গাড়ি পাল্টাতে হবে। এতে বেশি মানুষের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে, করোনার ঝুঁকিও বাড়ছে। এ দেশের মানুষ ঈদের সময় যেকোনো উপায়ে বাড়ি যেতে চায়। যারা নিয়ম তৈরি করে, তারা কী বিষয়টা জানে না, এভাবে মানুষের বাড়িফেরা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে না কমাচ্ছে?’