গায়েবি মামলায় সাংবাদিক আশরাফুল ১৪ দিন ধরে কারাগারে, দ্রুত মুক্তির দাবি

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বদরগঞ্জ নাগরিক পরিষদের ব্যানারে সাংবাদিক আশরাফুলের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করা হয়। বদরগঞ্জের স্থানীয় মহিলা ডিগ্রি কলেজের সামনে, ২৬ সেপ্টেম্বর
প্রথম আলো

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার সাংবাদিক আশরাফুল আলম ষড়যন্ত্রমূলক গায়েবি মামলায় ১৪ দিন ধরে কারাবন্দী রয়েছেন। আগামীকাল রোববার রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাংবাদিক আশরাফুলের জামিন শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।
এদিকে সাংবাদিক আশরাফুলকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ও দ্রুত মুক্তির দাবিতে আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বদরগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বদরগঞ্জ নাগরিক পরিষদ’ মানববন্ধন কর্মসূচি দিলেও পুলিশি বাধায় সেখানে তারা তা করতে পারেনি। পরে বেলা ১১টায় ওই মানববন্ধন করা হয় বদরগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজের সামনে।
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন বদরগঞ্জ নাগরিক পরিষদের সভাপতি আশরাফুল ইসলাম, বদরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহসভাপতি রুহুল আমিন সরকার, সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হজরত একরাম, আরিফুল ইসলাম ও কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম।

বক্তারা পুলিশের ষড়যন্ত্রমূলক গায়েবি মামলায় সাংবাদিক আশরাফুলকে গ্রেপ্তারের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে অবিলম্বে তাঁর মুক্তির দাবি জানান। তাঁরা বলেন, সাংবাদিক আশরাফুল সব সময় জামায়াতের বিরুদ্ধে লড়েছেন, লিখেছেন। তিনি প্রগতিশীল একজন সাংবাদিক। গায়েবি মামলার মূল এজাহারে তাঁর নাম না থাকলেও পুলিশ তাঁকে অভিযোগপত্রে আসামি করেছে। তাঁরা ওই সময়ে দায়িত্ব পালনকারী মামলার বাদী এসআই সিরাজুল ইসলাম, তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আতিকুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতারুজ্জামান প্রধানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান।
বদরগঞ্জ নাগরিক পরিষদের সভাপতি আশরাফুল বলেন, ‘উপজেলা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে পূর্বঘোষিত আমাদের মানববন্ধন কর্মসূচি ছিল। এ কর্মসূচি প্রতিরোধে সকাল আটটা থেকে সেখানে ছয়-সাতজন পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে একদল পুলিশ অবস্থান নেয়। বিশৃঙ্খলা এড়াতে বাধ্য হয়ে অন্যত্র মানববন্ধন করেছি। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারও এখন হরণ করা হচ্ছে।’
বদরগঞ্জ থানার বর্তমান ওসি হাবিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, সারা দেশে ভিপি নূরকে নিয়ে আন্দোলনের চেষ্টা চলছে। তাই এ মুহূর্তে কোথাও কোনো মানববন্ধন বা আন্দোলন করতে দেওয়া হবে না।

আশরাফুল আলম ইত্তেফাকের বদরগঞ্জ উপজেলার সাবেক সংবাদদাতা। বর্তমানে তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত আমার সংবাদ ও স্থানীয় দৈনিক প্রথম খবর–এর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বদরগঞ্জ পৌরসভার সাহাপুর গ্রামে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন।
আশরাফুলের পরিবারের অভিযোগ, ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি এসআই সিরাজুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলার আসামিকে ধরতে বাদীর কাছে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবির অভিযোগ এবং পরবর্তী সময়ে তাঁকে বদলি করার ঘটনায় একাধিক সংবাদ ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। আশরাফুল ওই সময়ে ইত্তেফাকের বদরগঞ্জ সংবাদদাতা ছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এসআই সিরাজুল থানার আরেক এসআই আতিকুরের যোগসাজশে একটি গায়েবি মামলার অভিযোগপত্রে সাংবাদিক আশরাফুলের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন।
আশরাফুলের পরিবার আরও জানায়, তারা ওই গায়েবি মামলা সম্পর্কে এত দিন কিছুই জানত না। ১৩ সেপ্টেম্বর উপজেলার আমরুলবাড়ি গ্রামের সড়ক থেকে আদালতের পরোয়ানামূলে পুলিশ আশরাফুলকে গ্রেপ্তার করে। তখন থেকে তিনি রংপুর কারাগারে বন্দী।
মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এসআই সিরাজুল বাদী হয়ে থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলাটি করেছিলেন। মামলায় এজাহারনামীয় আসামি করা হয় উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির, সেক্রেটারিসহ চার নেতাকে। এজাহারে সাংবাদিক আশরাফুলের নাম ছিল না।
মামলার এজাহারে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাত ১টার দিকে বদরগঞ্জ পুরোনো বাজারের বান্না ডিজিটাল নামক দোকানের ভেতরে অন্তর্ঘাতমূলক কাজের ষড়যন্ত্র করার উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠক চলছিল। এ সময় সেখানে অভিযান চালিয়ে পৌর জামায়াতের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ও জামায়াতের কর্মী হাবিবুর রহমানকে আটক করা হয়। তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, জামায়াতের ওই দুই নেতাকে ওই সময়ে নিজ বাড়ি থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁরা বর্তমানে জামিনে আছেন। ওই মামলায় জামায়াতের ৩০-৩৫ কর্মীকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। মামলার মূল এজাহারে সাংবাদিক আশরাফুলের নাম না থাকলেও ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি আদালতে দেওয়া ওই মামলার অভিযোগপত্রে পুলিশ তাঁকে আসামি করেছে। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তৎকালীন এসআই আতিকুর।

ওই মামলার সাক্ষী বদরগঞ্জ পৌরসভার বালুয়াভাটা গ্রামের আবু তালহা বলেন, ‘আমাকে ওই মামলায় পুলিশ সাক্ষী করেছে, তা জানতাম না। সাংবাদিক আশরাফুলকে আমি ভালোভাবে চিনি ও জানি। তিনি জামায়াত বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল করেন না। পুলিশ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁকে মামলায় ফাঁসিয়েছে।’ অনেকটা একই কথা বলেন, মামলার অপর সাক্ষী বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ওসমানপুর বিচিবাড়ী গ্রামের রেজাউল করিমও।
বদরগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বদরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র উত্তম কুমার সাহা বলেন, ‘সাংবাদিক আশরাফুলকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি ও জানি। তিনি জামায়াতবিরোধী প্রগতিশীল একজন সাংবাদিক। পুলিশ ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ওই মামলায় জড়িয়েছে। পুরো ঘটনাটি তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।’

এ ব্যাপারে তৎকালীন ওসি আখতারুজ্জামান প্রধান (বর্তমানে রংপুর মহানগরের তাজহাট থানার ওসি) বলেন, ‘মামলায় সাংবাদিক আশরাফুলের নাম জড়িয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। পুরো বিষয়টি আমার অগোচরে হয়েছে।’
এ বিষয়ে মামলার বাদী এসআই সিরাজুলের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই জানি না।’ পরে তিনি ফোন কেটে দেন।
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আতিকুর বলেন, ‘আমি তদন্ত কর্মকর্তা হলেও সবকিছু করেছেন মামলার বাদী এসআই সিরাজুল।’
এদিকে সাংবাদিক আশরাফুলকে গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তারের ঘটনায় বদরগঞ্জ প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে অবিলম্বে তাঁর মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ঘটনাটি তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানানো হয়েছে।