গুজবে বিভ্রান্ত চরবাসী, বাড়ি থেকে ডেকে এনে টিকাদান

বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে এসে এক বৃদ্ধাকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। আজ শনিবার বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের বিরামের পাঁচগাছি চরে
ছবি: আনোয়ার পারভেজ

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নে গণটিকা কার্যক্রমে চরাঞ্চলের মানুষের সাড়া মেলেনি। যমুনা নদীবেষ্টিত এই ইউনিয়নে ৬০০ মানুষকে আজ শনিবার টিকা দেওয়ার কথা ছিল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেকে এনে বিকেল পর্যন্ত তিন শর মতো মানুষকে টিকা দেওয়া গেছে। টিকা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গুজবের কারণে ‘আতঙ্কে’ মানুষজন টিকা নিতে আসেননি বলে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

শনিবার দুপুরের দিকে ইউনিয়নের শিমুলতাইড় চরে গিয়ে দেখা গেছে, শিমুলতাইড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় টিকাদান কেন্দ্র ফাঁকা। অলস বসে রয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী ও পুলিশের সদস্যরা। টিকা নিয়ে কেউ অসুস্থতা বোধ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তাও সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। তবে এত সব আয়োজনের পরও টিকা নেওয়ার লোক নেই।

দায়িত্বরত ব্যক্তিরা জানান, বিদ্যালয়টিতে টিকাদানের জন্য তিনটি বুথ স্থাপন করা হয়। কিন্তু আতঙ্কে টিকা নিতে আসেননি চরের বাসিন্দারা। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে টিকা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা অপেক্ষা করলেও দেখা মেলেনি মানুষের। পরে বাড়ি বাড়ি থেকে লোকজনকে ডেকে আনেন ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। তাতেও কাজ হয়নি। বেলা একটা পর্যন্ত চার ঘণ্টায় মাত্র ৬০ জনকে টিকা কেন্দ্রে আনা সম্ভব হয়। শেষে এই কেন্দ্রের দুটি বুথের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ৪০০ টিকা পাশের বিরামের পাঁচগাছি চরে পাঠানো হয়। সেখানে চালুয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বাড়ি। ফলে তিনি নিজেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে ডেকে অস্থায়ী টিকাকেন্দ্রে জড়ো করেন। বেলা চারটা পর্যন্ত এই অস্থায়ী টিকা কেন্দ্রে মাত্র ১৫০ জনকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়।

বেলা দেড়টার দিকে শিমুলতাইড় চরের ভোলা শেখ (৭৪) টিকা নিতে এসেছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সগলি কচ্চে, টিকা লিচ্চু তো মরিচ্চু। টিকা দিয়ে সরকার হামাগরক মারে ফালবি। গোটা চরজুড়ে গুজব উঠচে। এই ভয়ে কেউ টিকা লিবার আসিচ্চেনা। হামি অ্যানা সাহস করে টিকা লিবার আচ্চি। টিকার লিবার আসে মিচ্চি অ্যানা ভয় লাগিচ্চে, আবার টিকা না লিলে করোনা ধরবি, সিকনাও ভয় লাগিচ্চে।’

চালুয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জাহিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চরজুড়ে টিকা নিয়ে গুজব, আতঙ্ক। আমরা মসজিদের মাইকে মাইকে টিকা নেওয়ার জন্য প্রচারণা চালিয়েছি। তাতেও কোনো সাড়া মেলেনি। দুপুর পর্যন্ত কেন্দ্রে বসে আছি। শেষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে ডেকে আনার পর বেলা চারটা পর্যন্ত শ খানেক মানুষকে টিকা দেওয়া গেছে।’

ইউপি চেয়ারম্যান শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, যমুনা নদীর দুর্গম চর। ‘টিকা নিলেই প্রাণ যাবে’ এমন আতঙ্কের পাশাপাশি যাতায়াত সমস্যার কারণে অনেকেই টিকা কেন্দ্রে আসেননি। যেখানে টিকা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল সেখানে যোগাযোগব্যবস্থা খুব দুর্গম। অন্য চরে হলে উপস্থিতি আরও বেশি হতো। ৬০০ মানুষকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি থাকলেও সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ জনকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের পাশাপাশি গণটিকাবিমুখের এই চিত্র পাশের কাজলা এবং বহাইল ইউনিয়নের চরেও। তবে সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটশেরপুর, সদর, হাটফুলবাড়ী, নারচী, ভেলাবাড়ী, কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা ইউনিয়নে টিকা কেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি ভালো ছিল।

নিবন্ধন ছাড়াই টিকাদান

সকাল ১০টার দিকে জেলার গাবতলী উপজেলার সুখানপুকুর এম আর উচ্চবিদ্যালয় গণটিকাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, টিকা নেওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন। বেশির ভাগই বয়স্ক মানুষ। অনেকেই নিবন্ধন না করেই ইউপি সদস্যের দেওয়া স্লিপ নিয়ে টিকা নিতে এসেছেন। কেন্দ্রে নিবন্ধনের কোনো সুযোগ নেই।

কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সহকারী বলেন, এই কেন্দ্রে ৬০০ টিকার বরাদ্দ আগে থেকেই তিন ওয়ার্ডের তিনজন ইউপি সদস্যকে ২০০টি করে বরাদ্দ ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের দেওয়া স্লিপ অনুযায়ী টিকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু টিকা নিতে এসেছেন অনেক বেশি মানুষ। ৬০০ জনের বেশি কাউকে টিকা দেওয়ার সুযোগ নেই।

এই কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবক শাহানুর সাকিল বলেন, ‘আমরা কয়েক দিন ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বহু মানুষকে নিবন্ধন করে দিয়েছি। কিন্ত ইউপি সদস্যদের মাঝে টিকার বরাদ্দ ভাগাভাগি করে দেওয়ায় নিবন্ধিত অনেকেই টিকা নিতে এসে ফেরত যাচ্ছেন। ইউপি সদস্যের স্লিপ ছাড়া এখানে কাউকে টিকা দেওয়া হচ্ছে না।’

একই চিত্র বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলাতেও। এখানেও ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মাঝে টিকার বরাদ্দ ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে।

মাঝিড়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের স্বাস্থ্য সহকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ৬০০ জনের তালিকা করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী টিকা দেওয়া হয়েছে।

বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জেলার ১২টি উপজেলার ৩৫৭টি কেন্দ্রে একযোগে গণটিকা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে ২০০ জন ধরে মোট ৭১ হাজার ৪০০ জনকে সিনোফার্মার টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি ছিল। শনিবার কতজনকে টিকা দেওয়া হয়েছে, সেই তথ্য নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।

নিবন্ধন ছাড়াই ইউপি সদস্যদের স্লিপের মাধ্যমে টিকা দেওয়ার বিষয়ে ডেপুটি সিভিল সার্জন বলেন, কেন্দ্রে মানুষজনের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ইউপি সদস্যদের সহায়তায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে নিবন্ধন করে টিকা গ্রহণকারীদের বাড়ি বাড়ি টিকা কার্ড পৌঁছে দেওয়া হবে।