গোবরে ভরা কাচারি ভবন, জীর্ণ দাতব্য চিকিৎসালয়

হারিয়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ কাচারীবাড়ি। গোবর ও লতাপাতায় ছেয়ে গেছে বাড়িটি। গত মঙ্গলবার দুপুরে তোলা।  প্রথম আলো
হারিয়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ কাচারীবাড়ি। গোবর ও লতাপাতায় ছেয়ে গেছে বাড়িটি। গত মঙ্গলবার দুপুরে তোলা। প্রথম আলো

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত দুটি স্থাপনা। পাশে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড ঝোলানো। তাতে লেখা আছে, এই পুরাকীর্তির কোনো রকম ধ্বংস সাধন করা যাবে না। কোনো দাগ লাগানো যাবে না বা কোনো কিছু লেখা যাবে না। তবে এই সাইনবোর্ড ঝুলিয়েই রক্ষণাবেক্ষণের দায় শেষ। অযত্ন-অবহেলায় দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে স্থাপনা দুটি।

এ অবস্থা কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহে অবস্থিত ঠাকুর পরিবারের জমিদারির অংশ কাচারি ভবন ও দাতব্য চিকিৎসালয়ের। দাতব্য চিকিৎসালয়টি বয়সের ভারে জরাজীর্ণ। গাছগাছালি, লতাপাতায় জড়িয়ে আছে দেয়াল ও অন্দর। ঘরের ভেতরে কারুকাজ ছিল। তা ঢেকে গেছে ধুলো আর শেওলায়। সেখানে শালিক-চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছে। পরগাছায় ছেয়ে আছে পাশের কাচারিবাড়িটিও। ভবনের টালির ছাদ ধসে পড়ছে। বাইরের দেয়ালকে গোবরের ঘোষি শুকানোর কারখানা বানিয়ে ফেলেছেন আশপাশের লোকজন। অথচ এক শতাব্দী আগে এখানে রাজা-প্রজাদের আনাগোনা, খাজনা আদায় ও চিকিৎসাসেবায় ব্যস্ত থাকত এলাকাটি। সে সবই এখন স্মৃতি।

জানতে চাইলে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির কাস্টোডিয়ান মুখলেছুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই ওই কাচারি ভবন, দাতব্য চিকিৎসালয়সহ আরও কয়েকটি স্থাপনা পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে স্থাপনাগুলো সরকারিভাবে জেলা প্রশাসনের আওতায়। তাদের কাছ থেকে বন্দোবস্তের একটা প্রক্রিয়া চলছে। এটা হয়ে গেলেই সংস্কার করে সেখানে জাদুঘর বানানো হবে। এ ক্ষেত্রে মূল কুঠিবাড়ির সঙ্গে মিল রাখা হবে। আর পুরাকীর্তির গুরুত্ব তুলে ধরে তাঁরা প্রায়ই এলাকার মানুষদের সচেতন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা কেউই তা মানেন না। তাই পুরো স্থাপনা দেয়াল দিয়ে না ঘেরা পর্যন্ত কোনো কাজ হবে না।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, অযত্ন-অবহেলায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কিছু স্থাপনা পড়ে আছে, এটা সত্যি। তবে এগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জমি হস্তান্তরের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, আগে শিলাইদহের জমিদারি ছিল নাটোরের জমিদার পরিবারের অধীনে। তাদের কাছ থেকে এই জমিদারি কিনে নেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষেরা। জমিদারি পরিচালনার জন্য তাঁরা শুরুতে শেলি সাহেবের নীলকুঠি ব্যবহার করতেন। ভবনটি ছিল পদ্মার তীর ঘেঁষে। কিন্তু পদ্মার ভাঙনে নীলকুঠি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ১৮৯২ সালে ঠাকুর পরিবার শিলাইদহে কুঠিবাড়ি তৈরি করেন। রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে কুঠিবাড়ির পাশেই কসবা গ্রামে প্রজাদের জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি করেন। তার পাশেই ছিল খাজনা আদায়ের জন্য ব্যবহৃত কাচারি ভবন। এই জমিদারির সুবাদে তরুণ বয়স থেকেই শিলাইদহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ।

গত মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে কাচারি ভবন ও দাতব্য চিকিৎসালয়ের বেহাল চিত্র চোখে পড়ে। গাছগাছালি ও লতাপাতা এমনভাবে আঁকড়ে আছে যে ভবন দুটিকে চেনার উপায় নেই। এখানে-ওখানে খসে পড়ে থাকা ইটের টুকরা ভবন দুটির জরাজীর্ণ দশা জানান দিচ্ছে। ভবনের ছাদের টালিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। দাতব্য চিকিৎসালয়ের ছাদ নেই। দেয়ালগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও ন্যুব্জ অবস্থায় রয়েছে। ভবনের ভেতরে পাখিদের বসবাস।

কাচারি ভবনের সামনের দেয়ালে গোবর লেপতে দেখা গেল এক নারীকে। তিনি বললেন, আশপাশের সবাই এই কাজ করে। তাই তিনিও করছেন।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সরওয়ার মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, এই জায়গাগুলো কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত। স্থাপনাগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। তা না হলে এগুলো হারিয়ে যাবে। তার সঙ্গে মুছে যাবে কবিগুরুর স্মৃতিচিহ্ন। তখন নতুন প্রজন্ম তাঁর অনেক কিছুই আর জানতে পারবে না।