গোলাপে পেট চলছে না, চাষিরা ঝুঁকছেন অন্য ফসলে

কক্সবাজারের চকরিয়ার বরইতলীর গোলাপবাগান থেকে নষ্ট গোলাপ তুলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
ছবি: প্রথম আলো

তিন একর জমিতে গোলাপ চাষ করতেন কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের লামারপাড়ার নাছির উদ্দিন। বর্তমানে তা ৪০ শতকে নেমে এসেছে। বাকি জমিতে তামাক ও বিভিন্ন সবজির চাষ করছেন। কারণ জানতে চাইলে নাছির উদ্দিন (৩০) বলেন, গোলাপে পেট চলছে না। জীবন-জীবিকা হুমকিতে। তাই জীবন বাঁচাতে তামাক, ধানসহ সবজি চাষে ঝুঁকছেন তাঁর মতো চাষিরা।

কক্সবাজার শহর থেকে ৭৫ কিলোমিটার উত্তরে বরইতলী গ্রাম। একসময় বরইয়ের জন্য প্রসিদ্ধ গ্রামটি সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিতি পায় ‘গোলাপ গ্রাম বরইতলী’ নামে। এই গ্রামের রকমারি গোলাপ মন রাঙাত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের। এখন চাহিদা নেই, গাছের গোলাপ নষ্ট হচ্ছে গাছেই।

চাষিদের ভাষ্যমতে, দুই বছর আগেও বরইতলীতে প্রায় ২০০ একর জমিতে ২১০টি গোলাপের বাগান ছিল। এখন মাত্র ৯০ একরে ৭২টি বাগান। বেচাবিক্রি নেই বলে এসব বাগান থেকে এখন প্রতিদিন কয়েক হাজার গোলাপ কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে। তামাক চাষ ছেড়ে গোলাপ চাষে আসা চাষিরা জীবন বাঁচাতে পুনরায় তামাক চাষসহ নানা পেশায় ঝুঁকছেন। করোনা সংক্রমণরোধে কঠোর বিধিনিষেধ গোলাপচাষিদের জীবন-জীবিকা হুমকিতে ঠেলে দিয়েছে।

চকরিয়া পৌর শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে সোনাইছড়ি খাল। এই খালের দুই পাড়ে বিস্তীর্ণ গোলাপবাগান। উত্তর পাড়ে মঈনুল ইসলামের এক একরের গোলাপবাগান ‘রোজ গার্ডেন’।

গত ২৭ জুলাই বেলা ১১টায় রোজ গার্ডেনে গিয়ে দেখা গেল, বাগানের হাজারো গাছে ফুটেছে কয়েক হাজার গোলাপ। গাছ থেকে গোলাপ কাটছেন কর্মচারী কফিল উদ্দিন। তিনি গোলাপ কেটে ঝুড়িতে নিচ্ছেন, তারপর পাশের খালের পাড়ে ফেলে দিচ্ছেন।

কারণ জানতে চাইলে কফিল বললেন, বিধিনিষেধে গোলাপের চাহিদা নেই। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে গোলাপ নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট ফুল গাছে রাখা যায় না, গাছের ক্ষতি। প্রতিদিন এই বাগান থেকেই অন্তত এক হাজার গোলাপ কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে। বাগানে গাছ আছে প্রায় ২০ হাজার।

রোজ গার্ডেনের মালিক স্থানীয় খয়রাতিপাড়ার বাসিন্দা মঈনুল ইসলাম। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি ৩ একর জমিতে গোলাপের চাষ করে আসছেন। প্রতিবছরই লাভ করেছেন। এখন বাগান করছেন মাত্র এক একরে। বাকি দুই একরে ধান চাষ করছেন। তিনি বলেন, করোনার কারণে বিয়েশাদিসহ সামাজিক আচার অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ কারণে গোলাপের চাহিদা নেই। গাছের গোলাপ গাছেই নষ্ট হচ্ছে। দেড় বছর ধরে একটি বাগানেই তাঁর লোকসান গুনতে হয়েছে পাঁচ লাখ টাকার বেশি।

ফেলে দেওয়ার জন্য বাগান থেকে তোলা হয়েছে এসব গোলাপ। কক্সবাজারের চকরিয়ার বরইতলীতে
ছবি: প্রথম আলো

রোজ গার্ডেনের দক্ষিণে লাগোয়া সোনাইছড়ি খাল। খালের দক্ষিণ পাশে আনসার উদ্দিনের দুই একরের গোলাপবাগান। বাগানের ৩০ হাজার গাছ। এর মধ্যে অন্তত ৩ হাজার গাছে ফুটেছে লাল গোলাপ। কিন্তু ক্রেতা নেই। আনসার উদ্দিন (৪০) বললেন, সকাল ১০টা থেকে কয়েক ঘণ্টায় তিনি বাগান থেকে প্রায় ২ হাজার গোলাপ কেটে ফেলে দিয়েছেন।

বরইতলী গোলাপবাগান মালিক সমিতির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম বলেন, পাঁচ বছর আগেও প্রায় ২০০ একর জমিতে গোলাপের চাষ হতো। এখন মাত্র ৭০ জন ব্যক্তি প্রায় ৯০ একরে ৭২টি গোলাপের বাগান করছেন। বেচাবিক্রি না থাকায় প্রতিদিন এসব বাগান থেকে অন্তত ৮ হাজার গোলাপ কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে।

গোলাপচাষি এনামুল হকের দুই একরের বাগান ছিল। তিনি এখন এক একর জমিতে গোলাপবাগান করছেন। অন্য এক একরে তামাকের চাষ হচ্ছে। এনামুল বলেন, ‘গোলাপের চেয়ে তামাকে লাভ বেশি।’

সরেজমিন দেখা গেছে, বরইতলী ইউনিয়নের উপরপাড়া, নামারপাড়া, খয়রাতিপাড়া, বরইতলী নতুন রাস্তার মাথা, মাইজপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় তামাক, ধান, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়েছে। অথচ আগে এসব জমিতে গোলাপের চাষ হতো।

গোলাপচাষিদের নেতা মঈনুল ইসলামের মতে, গোলাপের বাজার দখল করেছে কাগজের ফুল ও চায়না ফুল। গোলাপ একবার ব্যবহারের পর আর ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু কাগজের ফুল বা চায়না ফুল অন্তত চার থেকে পাঁচবার ব্যবহার করতে পারে। বিয়েশাদি, সামাজিক অনুষ্ঠানে এখন কাগজের ফুল ব্যবহার হচ্ছে বেশি। লোকসান দিতে দিতে হয়তো একদিন বরইতলী আবার তামাক চাষে ভরপুর হবে।

ফুলের দোকানে এখন বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। কক্সবাজারের চকরিয়ার বরইতলীতে
ছবি: প্রথম আলো

তবে চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁর মতে, বরইতলী ও হারবাং এলাকায় ১৭৫ একর জমিতে গোলাপের চাষ হচ্ছে। গোলাপ চাষ ছেড়ে তামাক চাষে চাষিদের ঝুঁকে পড়ার তথ্য সঠিক নয়। হয়তো কয়েক মাসের টানা বিধিনিষেধের কারণে গোলাপচাষিরা কিছুটা সমস্যায় আছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গোলাপ চাষ আবার বেড়ে যাবে।

বরইতলী নতুন রাস্তার মাথা এলাকায় মায়ের দোয়া পুষ্পবিতান নামের একটি ফুলের দোকান রয়েছে। দোকানের স্বত্বাধিকারী আবিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিধিনিষেধে চট্টগ্রামের আড়তে কিছু গোলাপ যায়। এতে খরচই উঠে না। প্রতিটি গোলাপ মাত্র ৫০-৭০ পয়সায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আগে বিক্রি হতো এক টাকায়।

চাষিরা বলেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, পয়লা বৈশাখ ও বসন্ত, ১৬ ডিসেম্বরে গোলাপের প্রচুর চাহিদা দেখা দেয়। ওই সময় প্রতিটি গোলাপ ৮-১২ টাকায় বিক্রি হয়। তবে দেড় বছর ধরে প্রতিটি গোলাপবাগানের মালিকই লোকসান গুনেছেন। গাছের গোলাপ নষ্ট হচ্ছে গাছেই।