গোয়ালন্দে অসহায় মানুষকে ঈদ উপহার দিল বন্ধুসভা

ঈদের দিন সকালে দেবগ্রামের উত্তর কাওয়ালজানি গ্রামে ঈদের বাজার তুলে দিচ্ছেন গোয়ালন্দ বন্ধুসভার সদস্যরা
ছবি: প্রথম আলো


পিত্তথলিতে পাথর, পেটে ঘা হওয়াসহ নানা রোগে দীর্ঘদিন ধরে সীমাহীন কষ্ট ভোগ করে চলেছেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার বিপেন রায়পাড়ার হাছিনা বেগম (৫০)। আট মেয়ে ও এক ছেলের মা হাছিনা টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। স্বামী মজিবর রহমান ভাঙা হাঁড়ি-পাতিল মেরামত করেন। এই কাজ করেই যৎসামান্য যা পান, তাই দিয়ে টেনেটুনে সংসারের খরচ চলে। এরপর স্ত্রীর চিকিৎসাব্যয় মেটাতে প্রতিনিয়ত তাঁকে হিমশিম খেতে হয়।

পরিবারটির এ অসহায়ত্বের খবর পেয়ে বন্ধুসভার সদস্যরা অসুস্থ হাছিনা বেগমের হাতে তুলে দেন নগদ ১ হাজার টাকা ও ঈদ উপহার। এ সময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। হাছিনা বেগম বলেন, ‘বাজানরে কত মানুষের কাছে গেছি, কেউ তেমন সহযোগিতা করে না। প্রতিদিন ২০০ টাকার ওষুধ লাগে। এত টাকা কই পাব। আর মানুষের কাছেই কতবার হাত পাতব। তোমরা আমার এমন বিপদের দিনে যে পাশে আইছ, তাতেই আমি মহাখুশি।’

উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের উত্তর কাওয়ালজানি গ্রামে অন্যের জমিতে বাস করেন নদীভাঙনে সর্বহারা বিধবা চায়না বেগম (৬০)। দেবগ্রামের বেথুরী গ্রামে চায়না বেগমের একসময় চাষের জমি, ভিটেবাড়ি সবই ছিল। কিন্তু পদ্মার ভাঙনে ১০ বছর আগে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আজ তিনি অন্যের জমিতে বসবাস করছেন। ঈদের দিন সকালে বাড়িতে বন্ধুসভার সদস্যদের আনা ব্যাগভর্তি ঈদের বাজার দেখে তিনি প্রথমে অবাক হন। পরে বন্ধুসভার সদস্যরা ঈদের বাজারভর্তি ব্যাগ তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘এটি আপনার ঈদ উপহার।’ এ কথা শোনামাত্র তাঁর দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে।

এ সময় আবেগাপ্লুত চায়না বেগম বলেন, ‘বাবারা আজ ঈদের দিন। কত মানুষ কত কিছু খাচ্ছে। কেউ খোঁজ নিল না। তোমরা চাল, ডাল, চিনি, সেমাই, মসলা নিয়া আমাগোর খোঁজ নিবা, ভাবতে পারি নাই। ঈদের দিন রান্না করতে পারমু, ভাবতে অবাক লাগছে। তোমাগের জন্য পরান ভইরা দোয়া করি। আল্লাহ তোমাগের সুখে রাখুক, ভালো রাখুক, শান্তিতে রাখুক। তোমরা না আসলে ভালো-মন্দ কিছু রানবার পারতাম না।’

দেবগ্রাম জটু মিস্ত্রিপাড়া গ্রামে আগুনে নিঃস্ব পরিবারের লোকজনের মধ্যে ঈদের বাজার তুলে দিচ্ছেন গোয়ালন্দ বন্ধুসভার সদস্যরা
ছবি: প্রথম আলো

চায়না বেগমের স্বামী প্রায় ৩০ বছর আগে মারা গেছেন। এরপর স্বামীর ভিটাতেই দুই মেয়ে নিয়ে তবুও চলে যাচ্ছিল তাঁর জীবন। কিন্তু নদীভাঙনে কয়েক বছর আগে সব শেষ হয়ে গেলে তিনি সর্বহারা হয়ে পড়েন। অন্যের জমি বার্ষিক শনকরা নিয়ে কোনোরকমে কেটে যাচ্ছে তাঁর জীবন।
সম্প্রতি দেবগ্রামের জটু মিস্ত্রিপাড়া গ্রামে রান্নাঘরের চুলার আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয় দিনমজুর ফারুক শেখ, মোহাম্মদ শেখ, কাঞ্চন বিবি ও ময়না বেগমের ভিটেবাড়ি। এর মধ্যে কাঞ্চন বিবি (৭০) বাক্‌প্রতিবন্ধী। নিজের স্বামী, সন্তান বলতে দুনিয়ায় কেউ নেই। থাকেন সরকারিভাবে এ বছর তাঁর নামে বরাদ্দকৃত একটি ঘরে। মানুষের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে কোনোভাবে চলে এই বৃদ্ধার জীবন। তাঁর মতোই অসহায় বাকি তিনটি পরিবারও।
বন্ধুসভার সদস্যরা ঈদের বাজারভর্তি একটি ব্যাগ কাঞ্চন বিবির হাতে তুলে দিলে তিনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর আবেগ দেখে বন্ধুসভার সদস্যরাও আপ্লুত হয়ে পড়েন।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত আরেক অসহায় বিধবা ময়না বেগম (৬৫) বলেন, ‘মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে চলতাম। নিজের একটি ছাপড়া ছিল। আগুনে তা-ও শেষ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে রান্নাবান্না যা করি, নিজে তা খাই। আবার বৃদ্ধা কাঞ্চন বিবিকেও ডাক দিয়ে দুটো ভাত মুখে তুলে দিই।’

দেবগ্রাম জটু মিস্ত্রিপাড়া গ্রামে আগুনে নিঃস্ব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঈদের বাজার তুলে দিচ্ছেন গোয়ালন্দ বন্ধুসভার সদস্যরা
ছবি: প্রথম আলো

বন্ধুসভার সদস্যরা ময়না বেগমের হাতেও একটি প্যাকেট তুলে দেন। ঈদের বাজারভর্তি ব্যাগ পেয়ে আপ্লুত ময়না বেগম বলেন, ‘বাবারা তোমরা কোত্থেকে আইছ জানি না। তবে আল্লাই তোমাগেরে আমাগোর কাছে পাঠায়ছে। আল্লাহর কাছে পরানটা ভইরা দোয়া করি যেন তোমরা সুখে থাক।’

দৌলতদিয়া ব্যাপারীপাড়া গ্রামে ঈদের দিন সকালে শিশুদের হাতে মেহেদির প্যাকেট তুলে দিচ্ছেন গোয়ালন্দ বন্ধুসভার সদস্যরা
ছবি: প্রথম আলো

শুধু ঈদের বাজারই নয়, অনেকের হাতে নগদ টাকাও তুলে দেন বন্ধুসভার সদস্যরা। পাশাপাশি শিশুদের হাতে তুলে দেন মেহেদির প্যাকেট। ঈদের দিন পর্যন্ত গোয়ালন্দ পৌরসভা, উজানচর, দৌলতদিয়া, দেবগ্রাম ও ছোটভাকলা ইউনিয়নের অসহায় ৭৫টি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তাঁরা ঈদসামগ্রী এবং আরও ৭৫টি পরিবার ও কৃতী শিক্ষার্থীর হাতে নগদ টাকা তুলে দিয়েছেন। প্রত্যেক পরিবারকে ৫০০ টাকার ঈদসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। বন্ধুসভার সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচির আওতায় এসব সামগ্রী বিতরণ করা হয়।

ঈদে নগদ টাকা ও খাদ্যসামগ্রী তুলে দেওয়ার সময় প্রথম আলোর গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী প্রতিনিধি ও বন্ধুসভার উপদেষ্টা এম রাশেদুল হক, সভাপতি রমেশ কুমার আগরওয়ালা, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক জীবন কুমার চক্রবর্তী, সফিক মণ্ডল, কোষাধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম, সদস্য মইনুল হক মৃধা, ইমদাদুল হক পলাশ, নুরুল ইসলাম, রবিউল হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।