গৌড়বাংলা ও সুলতানি আমলের এত নিদর্শন আর কোথাও নেই

কোল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে ঐতিহ্য পর্যটক এলিজা বিনতে এলাহী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের কোল গ্রাম ফিল্টিপাড়ায় গত রোববার বিকেলেপ্রথম আলো

সুলতানি আমলের মুসলিম স্থাপত্যকলার এতগুলো নিদর্শন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো আর কোনো জেলায় নেই। একদা বাংলার রাজধানী গৌড়বাংলার অংশ এই জনপদে আছে সেন আমলের প্রাচীন নিদর্শন নওদা বুরুজ (ঢিবি)। অনেকে মনে করেন, এটি ছিল রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজপ্রাসাদ। আছে লোকসংস্কৃতি ঐতিহ্যের ‘আলকাপ’ ও ‘গম্ভীরা’ গানের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের বসবাস, তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি। নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্রের স্মৃতিবিজড়িত এলাকা এই জনপদ। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের মনের মাধুরী মিশিয় আঁকা আলপনা গ্রাম। আরও রয়েছে আম, লাক্ষা, রেশম, কাঁসা-পিতল, নকশিকাঁথা, কালাইয়ের রুটি, মেয়েলি গীতসহ আরও কত কিছু। পর্যটনকে আকর্ষণ করতে আর কী লাগে।

চার দিনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভ্রমণ শেষে কথাগুলো বলছিলেন ‘হেরিটেজ ট্রাভেলার’ (ঐতিহ্য পর্যটক) ও ‘ভ্রমণকন্যা’ হিসেবে খ্যাত এলিজা বিনতে এলাহী। এর আগে তিনি বাংলাদেশের ৬৪ জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ও ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (কালচারাল হেরিটেজ) অন্বেষণে ভ্রমণ শুরু করেছেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি ২৩-২৬ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভ্রমণ করেন।

আরও পড়ুন
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সুলতানি আমলের প্রাচীন ঐতিহ্য ছাদবিহীন দারশবাড়ি মসজিদে ঐতিহ্য পর্যটক এলিজা বিনতে এলাহী। গত রোববার বিকেলে
প্রথম আলো

দ্বিতীয় পর্যায়ের এই ভ্রমণে এলিজা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি লেখা, ছবি ও ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে তা তুলে ধরতে চান বলে জানান।

ভ্রমণকালে ২৬ অক্টোবর এলিজা সদর উপজেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের একটি কমলাবাগানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী লোক গম্ভীরা গানের দলের সঙ্গে বসেন। ২৫ অক্টোবর তিনি স্থানীয় নারী সংগঠন জাগো নারী বহ্নিশিখার সদস্যদের পরিবেশনায় মেয়েলি গীত শোনেন এবং তাঁদের হাতে কালাইয়ের রুটি বানানো দেখেন। ২৪ অক্টোবর তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলের কোল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকেদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দেখেন। এর পাশাপাশি তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর জেলার সবচেয়ে প্রাচীন সেন আমলের নিদর্শন নওদা বুরুজ, শিবগঞ্জ উপজেলায় সুলতানি আমলের ছাদবিহীন দারশবাড়ি মসজিদ, ছোট সোনামসজিদের চেয়েও পুরোনো দারশবাড়ি মাদ্রাসা ভ্রমণ করেন।

আরও পড়ুন
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গানের নানা ও নাতীর সঙ্গে ঐতিহ্য পর্যটক এলিজা বিনতে এলাহী। গত সোমবার বিকেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের একটি কমলা বাগানে
প্রথম আলো

নওদা বুরুজ দর্শনের পর এলিজা বলেন, এই ঢিবির আশপাশে আরও কিছু ঢিবি ছিল বলে বইপুস্তকে উল্লেখ আছে। কিন্তু এখানে নওদা বুরুজ ছাড়া আর কোনো ঢিবি এখন আর নেই। বুরুজের আশপাশের সব জমি দখল হয়ে বসতি গড়ে উঠেছে। বুরুজের ছোট ছোট ইট নিয়ে গিয়ে মানুষ ঘর তৈরি করেছে। এটি সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো নজরদারি নেই।

এই ঢিবি সম্পর্কে এলিজা বলেন, একসময় বাংলার রাজধানী ছিল নবদ্বীপ। নবদ্বীপ থেকেই এসেছে নওদা বা নদীয়া। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি লক্ষ্মণ সেনের রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করলে বিক্রমপুরে পালিয়ে যান লক্ষ্মণ সেন। এটিই লক্ষ্মণ সেনের রাজপ্রাসাদের অংশবিশেষ বলে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকের ধারণা। তবে এই ঢিবির নিচে কী আছে, তা এখনো অজানা। এটির উৎখনন হওয়া দরকার। উৎখনন হলেই জানা যাবে প্রাচীন বাংলার নানা অজানা ইতিহাস।

২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভার সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন এলিজা। জেলায় পর্যটন আকর্ষণে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যমণ্ডিত সবকিছু ভালোভাবে জানার আহ্বান জানিয়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব তুলে ধরার আহ্বান জানান। বন্ধুসভার সদস্যদের খণ্ডকালীন ট্যুরিস্ট গাইড হতে উদ্বুদ্ধ করেন। এ সময় এলিজা বলেন, হেরিটেজ টুরিজমের ক্ষেত্রে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অনন্য এক জেলা।

আরও পড়ুন

এর আগে এলিজা বিনতে এলাহী ভ্রমণ করেন এশিয়া ও ইউরোপের ৪৭টি দেশ। সংগ্রহ করেন সেখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নানা তথ্যউপাত্ত। এশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ইতিমধ্যে তাঁর দুটি প্রকাশনা রয়েছে। এর একটি এলিজাস ট্রাভেল ডায়েরি’, আরেকটি এলিজাস ট্রাভেল ডায়েরি-২

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক এলিজা বিনতে এলাহী নেদারল্যান্ডসের হেগ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সে অধ্যয়নরত। বর্তমানে শিক্ষাছুটিতে থাকা এই বিশ্ব পর্যটকের গবেষণার বিষয়ও ‘বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে হেরিটেজ টুরিজমের গুরুত্ব’। নিজের উপার্জিত অর্থে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ এবং এগুলোর প্রতি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন এই বিশ্ব ভ্রমণকন্যা। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইতিমধ্যে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘কোয়েস্ট–আ হেরিটেজ জার্নি ফর ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি প্রকল্প।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন