গ্যাসলাইন ঘিরেই সন্দেহ

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মর্গের সামনে কফিনের সারি। গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে পশ্চিম তল্লা মসজিদে বিস্ফোরণে নিহতদের লাশ এসব কফিনে করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়ছবি: সাজিদ হোসেন

নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লার বাসিন্দারা কখনো ভাবেননি, লাশের খাটিয়ার সংকট হবে তাঁদের। কিন্তু বাস্তবে সেই অবস্থাই ঘটল। গতকাল শনিবার ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে যখন একে একে মুসল্লিদের মৃত্যুর খবর আসছিল, তখন খাটিয়ার খোঁজে আশপাশের মসজিদে ছোটাছুটি করছিলেন লোকজন।

শুক্রবার রাতে এই পশ্চিম তল্লার বায়তুল সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটে। এশার নামাজ আদায় করতে যেসব মুসল্লি মসজিদে এসেছিলেন, কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে দগ্ধ অবস্থায় টেনেহিঁচড়ে বের করে আনতে হয়েছিল তাঁদের। যন্ত্রণায় কাতর মুসল্লিদের অনেকেই কষ্ট লাঘবের জন্য গড়াগড়ি খেয়েছিলেন মসজিদের সামনের রাস্তায় জমে থাকা সুয়ারেজের পানিতে। তাঁদের কারও কারও গায়ের চামড়াও খসে পড়ছিল। মসজিদের আঙিনায় গতকাল সেই চিহ্ন দেখা গেছে।

বিস্ফোরণে গুরুতর আহত ৩৭ জনকে রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। গতকাল শনিবার এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এক শিশুসহ তাঁদের ২০ জনই প্রাণ হারিয়েছেন। বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।

মুসল্লিদের এই করুণ পরিণতির বিষয়টি ছাপিয়ে এখন বিস্ফোরণের কারণ কী, তা নিয়েই চলছে আলোচনা। ঘটনা খতিয়ে দেখতে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা, ফরেনসিক ইউনিট, ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞ দল, মন্ত্রী, সাংসদসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

ঘটনাস্থলে আসা বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছ থেকে মোটা দাগে যে বিষয়টি জানা গেছে, মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়া তিতাস গ্যাসের সংযোগ থেকে ছিদ্র পথে গ্যাস বেরিয়ে ভেতরে ঢোকে। তারপর কোনো একপর্যায়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকে বিস্ফোরণ হয়। মসজিদ কমিটিসহ এলাকার লোকজন বিস্ফোরণের জন্য তিতাস গ্যাসকে দায়ী করেছেন। তাঁদের দাবি, গ্যাসের পাইপ ফুটো হওয়ার খবর জানানোর পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, আগুনের স্থায়িত্ব ছিল কম। সে কারণে পোড়া দাগও কম। ধোঁয়ারও কোনো চিহ্ন নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে গ্যাসের সংযোগ থেকেই বিস্ফোরণ হয়েছে।

গ্যাসের সংযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত কীভাবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, মসজিদে দুটি বিদ্যুতের লাইন আছে। বিদ্যুতের মেইন সুইচের কাছে বড় ধরনের ত্রুটি দেখা গেছে। সেখানে পোড়া দাগও আছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নামাজের শেষ সময়ে একটি লাইনের বিদ্যুৎ–সংযোগ চলে গেলে অন্য লাইনের সংযোগ চালু করতে গেলেই আগুনের সূত্রপাত হয়। ওই মসজিদে দুটি লাইনের সংযোগ ছিল।

নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে পশ্চিম তল্লা মহল্লা। বিস্ফোরণের শিকার মসজিদটির নাম বায়তুল সালাত হলেও এটি পরিচিত‍ ‘তল্লা চামার বাড়ি মসজিদ’ নামে। এলাকাবাসী জানান, ১৯৯১ সালে মসজিদটি পাকা করা হয়।

পুড়ে গেছে প্লাস্টিকের অংশগুলো

মসজিদ ভবনটি ইংরেজি বর্ণ ‘এল’ আকৃতির। দুই তলা মসজিদের নিচের তলার মূল অংশে নামাজ পড়া হয়। দ্বিতীয় তলার এক পাশে পাঁচটি কক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ ভাড়া থাকেন। এই ভবনের পেছন দিকে চারতলা আরেকটি ভবন আছে। সেখানেও অনেকে ভাড়া থাকেন। বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শুধু মসজিদের নিচের তলা। কাচের বেষ্টনী দিয়ে নিচের তলা দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। ভেতরের দিককার ৯টি সারিতে ৯৯ জন মুসল্লি দাঁড়াতে পারতেন। আর বাইরের বারান্দা আকৃতির জায়গাটিতে চারটি সারিতে ৩২ জন দাঁড়াতে পারতেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিস্ফোরণের পরও মসজিদের কাচের জানালাগুলো অক্ষত আছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, কাচের বেষ্টনী অক্ষতই ছিল। আহতদের উদ্ধার করার জন্য বিস্ফোরণের পর তাঁরা সেটি ভাঙেন। মসজিদের ভেতের থাকা ৬টি এসি, ২৬টি সিলিং ফ্যান রয়েছে। এসব ইলেকট্রনিকসামগ্রীর প্লাস্টিকের অংশগুলো পুড়ে গেছে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় বেশ কিছু সিলিং ফ্যানের পাখা দুমড়ে গেছে। শুধু মসজিদের উত্তর কোণের একটি ফ্যানের লোহার অংশেও পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন রয়েছে। এ ফ্যানটির কাছে রয়েছে বিদ্যুতের লাইন পরিবর্তনের সুইচটি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, এখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত।

নিচে নেমেই তিনি দেখতে পান মানুষের শরীরে আগুন জ্বলছে। অন্য কোনো কিছুতে তিনি আগুন লাগতে দেখেনি।
আমিনুল ইসলাম, মসজিদের দোতলার ভাড়াটে

বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে মুসল্লিদের উদ্ধার করতে প্রথম এসেছিলেন মসজিদের দোতলার ভাড়াটে আমিনুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নিচে নেমেই তিনি দেখতে পান মানুষের শরীরে আগুন জ্বলছে। অন্য কোনো কিছুতে তিনি আগুন লাগতে দেখেনি। তিনি জুতা রাখার প্লাস্টিকের বাক্স দিয়ে কাচের বেষ্টনী ভেঙে ফেলেন। এরপর লোকজন হুড়োহুড়ি করে বের হয়ে আসেন।

মসজিদ কমিটি ও তিতাস গ্যাসের অবহেলার অভিযোগ

মসজিদে বিস্ফোরণের জন্য মসজিদ কমিটি ও তিতাস গ্যাসের অবহেলাকে দায়ী করেছেন এলাকার বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, মসজিদে গ্যাসের গন্ধ তাঁরা অনেক দিন ধরেই পাচ্ছিলেন। মসজিদ কমিটির সদস্যরাও এখানে নামাজ পড়েন। তাঁরাও বিষয়টি জানেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেননি।

আমির হোসেন নামে এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই মসজিদের ভেতর থেকে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ার সময়ও সেজদা দিতে গিয়ে তাঁরা গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন।

৮-৯ দিন ধরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। বিষয়টি কমিটির সাধারণ সম্পাদক হান্নান সাউদ তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। তখন সংযোগ ঠিক করে দেওয়ার শর্তে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়।
আবদুল গফুর, মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য

মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল গফুর প্রথম আলোকে বলেন, ৮-৯ দিন ধরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। বিষয়টি কমিটির সাধারণ সম্পাদক হান্নান সাউদ তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। তখন সংযোগ ঠিক করে দেওয়ার শর্তে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। কিন্তু তাঁরা টাকা জোগাড় করতে না পারায় গ্যাসের ছিদ্র মেরামত হয়নি।

তিতাস গ্যাসের কাকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল, তা জানাতে পারেননি আবদুল গফুল। তাঁর দাবি, পুরো বিষয়টি হান্নান সাউদ দেখছিলেন। তিনিও দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন।

মসজিদ কমিটির অভিযোগের ব্যাপারে জানতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মফিজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গ্যাস ছিদ্রের বিষয়ে তাঁদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। টাকা দাবির অভিযোগও সত্য নয়।

বিস্ফোরণের পর গ্যাস সরবরাহ বন্ধ

মসজিদে বিস্ফোরণের পর থেকে পশ্চিম তল্লার আশপাশের এলাকার গ্যাস–সংযোগ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। পশ্চিম তল্লা এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মনির হোসেন জানান, বিস্ফোরণের পর মধ্যরাত থেকে তাঁদের এলাকায় গ্যাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গ্যাস না থাকায় সিলিন্ডার দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ করছেন।

তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্ঘটনা এড়াতে ওই এলাকার আশপাশের গ্যাসের সরবরাহ চাপ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তিন তদন্ত কমিটি

মসজিদে বিস্ফোরণের কারণ উদ্‌ঘাটনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্মণ, উপপরিচালক (অপারেশন) নুর হাসান ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আরেফিন। তদন্ত কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) খাদিজা তাহেরীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি ৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে।

আর তিতাস গ্যাস ঢাকা অফিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্লানিং) আবদুল ওয়াহাব তালুকদারকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

নিহতের লাশ দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা নারায়ণগঞ্জ প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন।

অব্যবস্থাপনার কথা বললেন প্রতিমন্ত্রী

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল বেলা তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে যান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এলাকার লোকজন বলেছেন মসজিদের বর্ধিত অংশের নিচে তিতাসের গ্যাসের সংযোগ আছে। রাস্তা খোঁড়ার পরই বোঝা যাবে, সেই সংযোগ কীভাবে এখানে এসেছে। মন্ত্রী বলেন, এই মসজিদে যেভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র লাগানো হয়েছে, সেটা আদৌ ঠিক হয়েছে কি না, বা সেখানে বিদ্যুতের অনুমোদিত চাপ আছে কি না, তা দেখা উচিত। এ ধরনের মসজিদে এত এসির ব্যবহার খুবই বিপজ্জনক। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরে যত ভবন হয়েছে, প্রায় সবই অবৈধ। এগুলোর একটাও রাজউকের অনুমোদন নিয়ে করা হয়নি।