গ্রামটি এখন ‘হাড়ভাঙা চিকিৎসার’ হাট

চুয়াডাঙ্গা থেকে অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে নাটোরের লালপুর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে এসেছে। সম্প্রতি গ্রামের একটি কবিরাজ বাড়ির সামনে।ছবি: প্রথম আলো

ঘটনাটি ২০১০ সালের। নাটোরের লালপুর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে গিয়ে জানা গেল, কয়েকটি বাড়িতে হাসপাতাল চালানো হচ্ছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, বাড়িতেই অনুমোদন ছাড়া ২০ শয্যার হাসপাতাল চালানো হচ্ছে। এ নিয়ে ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি প্রথম আলোতে সংবাদ প্রকাশিত হলে অনুমোদনহীন হাসপাতাল নিয়ে তৎপর হয় প্রশাসন।

নাটোরের লালপুর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে গিয়ে জানা গেল, কয়েকটি বাড়িতে হাসপাতাল চালানো হচ্ছে।
ছবি: প্রথম আলো

এর ১০ বছর পর গ্রামটিতে গিয়ে রীতিমতো চমকে যেতে হয়। গ্রামটির ঘরে ঘরে এখন হাড়ভাঙা ‘চিকিৎসাকেন্দ্র’। বাড়িতে বাড়িতে ঝুলছে ‘কবিরাজবাড়ি’ লেখা সাইনবোর্ড। একেকটি বাড়িতেই একটি করে হাসপাতাল। এই গ্রামের একসময়ে যাঁরা দিনমজুরি বা অন্যান্য পেশায় যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন বাড়িতে হাসপাতাল খুলে ‘চিকিৎসক’ বনে গেছেন। সেখানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গাড়িতে, অ্যাম্বুলেন্সে হাড়ভাঙা রোগীরা ‘চিকিৎসা’ নিতে আসছেন। এই গ্রামে রোগীরা কেবল আসেই না, এখানকার কথিত চিকিৎসকেরা অন্য এলাকায় চিকিৎসা দিতে যাচ্ছেন। বিরাট এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে নিভৃত গ্রামের মোড়ে বাজার গড়ে উঠেছে। টিনশেডের বাড়িগুলোর জায়গায় ১০ বছরে বহুতল দালান হয়েছে। অনুমোদনহীন এসব চিকিৎসাকেন্দ্র কী করে দিনের পর দিন চলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বিশিষ্ট হাড়জোড়া শল্যবিদ (অর্থপেডিক সার্জন) অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘খোলা মন নিয়ে বিষয়টি অনুসন্ধান করা দরকার। এত মানুষ কেন ওই গ্রামটিতে যাচ্ছে, তা তলিয়ে দেখা দরকার। কবিরাজেরা হাড়জোড়ার যে চিকিৎসা দেন, তার কিছু ভালো হয়, কিছু ভালো হয় না। সাধারণ হাড়ভাঙা রোগীকে কবিরাজেরা চিকিৎসা দিয়ে জটিল করে ফেলেন। তখন হাসপাতালেই আসতে হয়।’

হাড়ভাঙা চিকিৎসার গ্রাম

গত ২৪ ডিসেম্বর ইসলামপুর গ্রামে ঢুকতেই দেখা যায়, সুবিশাল একটি ত্রিতল ভবন। আগে সেখানে কিছুই ছিল না। ভবনের সামনের সাইনবোর্ডে লেখা— ‘কবিরাজবাড়ি। কবিরাজ মরহুম আবুল হোসেন’। ব্রাকেটে লেখা ছেলে লাহাব। এই সাইনবোর্ডে একটি গোলাপ ফুলের ছবি দিয়ে লেখা রয়েছে, ‘হাড়ভাঙা চিকিৎসা’ করা হয়। এই কবিরাজকে সেদিন পাওয়া যায়নি। ২০ শয্যার হাসপাতালসহ এটি তাঁর বাড়ি।

পরে মুঠোফোনে কথা হলে কবিরাজ লাহাব বলেন, দেশের ৬৪ জেলার ৬০ জেলা থেকেই তাঁর কাছে রোগী আসেন। অন্তত ১০ জন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় রয়েছে। তাঁরা তাঁর চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রয়েছেন। ১০ বছর আগে একবার পত্রিকায় খবর হওয়ার পরে তাঁর খুব ঝামেলা হয়েছিল। তবে তিনি প্রশাসনের সর্বোচ্চ দপ্তর পর্যন্ত গেছেন। তিনি মানুষের সেবা করছেন। কারও কোনো ক্ষতি করছেন না। তাঁর সব কথা শুনে কেউ তাঁকে আটকাতে পারেননি।

তিনি দাবি করেন, তাঁর বাবা আবুল হোসেনই এই গ্রামের প্রথম এই চিকিৎসাপদ্ধতি চালু করেন। তিনি প্রায় ৩৫ বছর চিকিৎসা করেছেন। ২০০৭ সাল থেকে তিনি বাবার পেশায় যোগ দিয়েছেন। ২০১৭ সালে বাবা মারা যাওয়ার পরে তাঁরা দুই ভাই পৃথকভাবে এ ব্যবসা করছেন।

বাড়িতে বাড়িতে ঝুলছে ‘কবিরাজবাড়ি’ লেখা সাইনবোর্ড।
ছবি: প্রথম আলো

১০ বছর আগে গ্রামের কবিরাজ আবদুল মান্নানের বাড়িতে গিয়ে ২০ শয্যার হাসপাতাল পাওয়া গিয়েছিল। তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৫ বছর। বলেছিলেন, ২২ বছর থেকে তিনি এই চিকিৎসা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এবার গিয়েও তাঁকে তাঁর কবিরাজবাড়ির সামনেই বসা অবস্থায় পাওয়া গেল। আগে তাঁর একটি হাসপাতাল ছিল। সেটি ছিল টিনশেডের ঘর। তার পাশে ছিল চাটাইয়ের বেড়া দেওয়া একটা অংশ। এখন গ্রামের শেষ মাথায় আরেকটি করেছেন। নতুনটিতে গিয়ে দেখা গেল প্রাসাদতুল্য ত্রিতল ভবন। তার পাশেই টিনশেডের ডরমিটরি আকারের লম্বা হাসপাতাল ভবন। তার পেছনেই রান্নার জায়গা। সেখানে ভর্তি রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা রোগী সোহেল (৩০)। দুই মাস ধরে তিনি স্ত্রীসহ এখানে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁর একটি পা কাঠের ফ্রেমের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। সোহেল বললেন, চারবার অস্ত্রোপচারের পর এখানে এসেছেন। উন্নতি হয়েছে।

নাটোরের সিংড়া থেকে এক মাসে আগে এসেছেন আতাউর রহমান (৪০)। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একবার গিয়ে আর যাননি। সেখানে ১০–১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখানে ৫০ হাজার টাকার চুক্তিতে ভর্তি হয়েছেন। ঈশ্বরদী থেকে ১৩ দিন আগে এসেছেন রাঙ্গা (২৫)। তাঁর সঙ্গে ২০ হাজার টাকা চুক্তি হয়েছে। ভালো হওয়ার পরে টাকা দেবেন।

গ্রামের ভেতরে ঢুকে ডানে–বাঁয়ে দুই পাশেই চোখে পড়ে কবিরাজবাড়ির সাইনবোর্ড। তখন বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। চুয়াডাঙ্গা থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে একটি কবিরাজবাড়ির সামনে দাঁড়াল। এটি আবুল হোসেনের আরেক ছেলে মকবুল হোসেনের হাসপাতাল। সেখানে ২০ জন রোগীর শয্যা রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে হাফিজুর রহমান (৪০) নামের একজন রোগীকে নামানো হলো। মোটরসাইকেলের সঙ্গে ইজিবাইকের সংঘর্ষের তাঁর একটি পা ভেঙে গেছে। চুয়াডাঙ্গা থেকে স্থানীয় চিকিৎসকেরা তাঁকে কুষ্টিয়া হাসপাতালে ‘রেফার্ড’ করেছিলেন। রোগীর এক স্বজন বলেন, তাঁরা হাসপাতালে না নিয়ে সরাসরি এখানে চলে এসেছেন। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল টেবিল–চেয়ার পেতে বসে আছেন মকবুল হোসেন। সেখানে হাসপাতালের মতোই জনসমাগম। একটা গমগমে পরিবেশ। রোগীর সঙ্গে স্বজনেরাও কবিরাজবাড়িতে এসে থাকেন। তাঁদেরও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে ভোলা থেকে আসা রোগী রুবেল (২২) ১ মাস ১২ দিন ধরে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সাত হাজার টাকার চুক্তি হয়েছে। অবশ্য খাবার বিল আলাদা।

পাওয়া গেল এ রকম একজন ‘দিনমজুর কাম চিকিৎসককে’। তাঁর নাম সামিউল ইসলাম (৩৭)। তিনি স্বীকার করলেন, তিনি লেখাপড়া জানেন না কিন্তু এই চিকিৎসাটা শিখেছেন। নওগাঁর রানীনগরে চেম্বার রয়েছে তাঁর। সপ্তাহে এক দিন সেখানে বসেন।

কবিরাজ মনিরুজ্জামানের বাড়িসহ তিনতলা ভবন। নিচতলায় হাসপাতাল। আগে ছিল টিনশেডের বাড়ি। সেখানেও একই রকম ব্যবস্থা। সেখানে পাওয়া গেল জয়পুরহাটের রোগী মমতাজকে (৭১)। তিনি ১০ দিন আগে এসেছেন। ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে তাঁর চিকিৎসা চলছে। রাজশাহীর নওহাটা থেকে এসেছেন রুস্তম আলী (৪৩)। তিনি ৫৫ দিন ধরে এখানে আছেন। তাঁর চুক্তি ১৫ হাজার টাকা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আট দিন থাকার পরে ছুটি দিয়েছিল। পরে হাসপাতালে ফিরে না গিয়ে কবিরাজবাড়িতে এসেছেন। পাবনা থেকে এসেছে আতিকুর রহমান (১৭)। সে ১৫ হাজার টাকায় কবিরাজের সঙ্গে চুক্তি করেছে।

অন্য ব্যবসাও জমজমাট

এই কারবারকে কেন্দ্রে করে গ্রামের মোড়ে বাজার গড়ে উঠেছে। গ্রামের ভেতরেও দোকানপাট বসেছে। গ্রামের মোড়ের বাজার ছাড়াও কবিরাজবাড়িগুলোর সামনেও দোকান দেখা গেল। দোকানি গোলাম মোরশেদ বললেন, তাঁর দোকানে সবকিছুই আছে। চিকিৎসাধীন রোগী ও তাঁর স্বজনদের খাওয়াদাওয়াসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই তাঁরা রেখেছেন। তিনি বলেন, কবিরাজবাড়ির কারণেই তাঁদের ব্যবসা হয়। যেমন গ্রামের ৬০-৬৫ পরিবার এখন এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই দিনমজুর। তাঁরা এখন পেশা বদল করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই চিকিৎসা দিতে যান। সেখানেই পাওয়া গেল এ রকম একজন ‘দিনমজুর কাম চিকিৎসককে’। তাঁর নাম সামিউল ইসলাম (৩৭)। তিনি স্বীকার করলেন, তিনি লেখাপড়া জানেন না কিন্তু এই চিকিৎসাটা শিখেছেন। নওগাঁর রানীনগরে চেম্বার রয়েছে তাঁর। সপ্তাহে এক দিন সেখানে বসেন।

একজন ব্যবসায়ী বলেন, এই গ্রামের ভ্যানচালকেরা এখন দিনে ৫০০ টাকা আয় করেন। আর বাজার তো দেখতেই পাচ্ছেন। আগে কিছুই ছিল না।

চিকিৎসা না অপচিকিৎসা

গ্রামের মোড়ে পল্লিচিকিৎসক রাজীব হোসেনের ওষুধের দোকান। রাজীব বলেন, ‘ডাক্তারের কাছে শুনবেন, বলবে এটা অপচিকিৎসা। আর যাঁরা এখান থেকে সুস্থ হয়ে ফিরছেন, তাঁদের কাছে শুনবেন, তাঁরা বলবেন, এখানে উপকার পাচ্ছেন। এখন কারটা মানবেন? পঙ্গু হাসপাতালে পা কেটে ফেলতে বলা হয়েছে, সেই রোগীরা আবার এখানে আসেন।’

এখানকার কবিরাজ লাহাবের দাবি, তাঁদের বিশেষ চিকিৎসাপদ্ধতিতে মানুষ উপকার পায় বলেই এখানে আসেন। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘লালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অন্তত ২০০টি শয্যা রয়েছে। মানুষ সেভাবে সেবা পায় না। এই হাসপাতালটি যদি আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমি সরকারকে ইজারামূল্য দেব এবং দেশের মধ্যে এই হাসপাতালের নাম ছড়িয়ে দেব।’

তবে এই চিকিৎসার ঝুঁকি আছে বলে জানান বিশিষ্ট অর্থপেডিক সার্জন ও পঙ্গু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক আবদুল আউয়াল রিজভী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাড়জোড়া চিকিৎসা সনাতন চিকিৎসাব্যবস্থা। কিন্তু এতে কিছু ঝুঁকি আছে। কবিরাজদের ব্যান্ডেজের কারণে অনেক ক্ষেত্রে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়, পরে হাত-পা কেটে ফেলতে হয়। অনেক সময় ভুল ব্যান্ডেজের কারণে হাত বা পা কার্যকারিতা হারায়। তৃতীয়ত, অনুমাননির্ভর এই চিকিৎসায় অনেক ক্ষেত্রে ভাঙা হাড় ঠিকমতো জোড়া লাগে না। মানুষ সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে। তিনি বলেন, একটি এলাকায় অনুমোদনহীন এতটা হাসপাতাল বা ক্লিনিক কেন হলো, তা প্রশাসনের অনুসন্ধান করা উচিত। এসব ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পেছনে বাটপার ও দালাল চক্র কাজ করে।

ডাক্তারের কাছে শুনবেন, বলবে এটা অপচিকিৎসা। আর যাঁরা এখান থেকে সুস্থ হয়ে ফিরছেন, তাঁদের কাছে শুনবেন, তাঁরা বলবেন, এখানে উপকার পাচ্ছেন। এখন কারটা মানবেন? পঙ্গু হাসপাতালে পা কেটে ফেলতে বলা হয়েছে, সেই রোগীরা আবার এখানে আসেন।
পল্লিচিকিৎসক রাজীব হোসেন

ওই গ্রামে হাড়ভাঙা চিকিৎসার কথা আগে থেকেই জানেন নাটোরের সিভিল সার্জন মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই গ্রামে তাঁরা যাবেন। যাঁদের কোনো লাইসেন্সই নেই, তাঁরা এভাবে চিকিৎসা দিচ্ছে! এটা হয় না। সিভিল সার্জন বলেন, তিনি মনে করেন না যে দারিদ্র্যের কারণে মানুষ সেখানে যাচ্ছে। হাসপাতালে তো মানুষ বিনা পয়সা চিকিৎসা পায়। হাসপাতালে সব সময় শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি থাকে। তারপরেও মানুষ কেন কবিরাজের কাছে যাচ্ছে, গেলে কী হচ্ছে, তাঁরা তা দেখতে যাবেন।