গ্রেপ্তারের তিন দিন পর যুবকের মৃত্যু, পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ

রেজাউল করিম

বরিশালে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যদের হাতে গ্রেপ্তারের তিন দিন পর রেজাউল করিম ওরফে রেজা (৩০) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়।

নিহত রেজাউল নগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাগরদী বাজারের মাংস ব্যবসায়ী মো. ইউনুস মুনসির ছেলে। তিনি বরিশাল আইন মহাবিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, আটকের পর পুলিশের নির্যাতনের কারনেই রেজাউলের মৃত্যু হয়েছে।

নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলছে, মাদকসহ রেজাউলকে গ্রেপ্তারের পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তবে অভিযোগ ওঠায় ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করেছে বরিশাল মহানগর পুলিশ।

নিহত রেজাউলের ফুফা বারেক হাওলাদার বলেন, গত ২৯ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে নগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের হামিদ খান সড়কের একটি চায়ের দোকানের সামনে থেকে রেজাউলকে আটক করেন বরিশাল নগর ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) মহিউদ্দিন আহমেদ। রেজাউলের কাছে মহিউদ্দিন দুজন মাদক ব্যবসায়ীর নাম জানতে চান। তবে রেজাউল কিছু জানেন না বললে তাঁর পকেটে হাত দিয়ে নেশাজাতীয় ইনজেকশন পাওয়ার দাবি করে তাঁকে আটক করে নিয়ে যান তিনি।

এই বিষয়ে এসআই মহিউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য, ২৯ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে রেজাউলকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাঁর সঙ্গে ১৩৬ গ্রাম গাঁজা ও ৪টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন পাওয়া যায়। ওই দিন রাত পৌনে ১২টায় তাঁকে কোতোয়ালি মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়। রাতেই মামলা করা হয় এবং পরের দিন আদালত রেজাউলকে কারাগারে পাঠান। রেজাউলের বিরুদ্ধে আগে থেকেই মাদক মামলা আছে এবং তিনি মাদকাসক্ত। তাঁকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি।

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক হরে কৃষ্ণ সিকদার বলেন, রক্তক্ষরণের কারণে ১ জানুয়ারি ৯টা ৩৫ মিনিটে হাসপাতালের পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে রেজাউলকে ভর্তি করে কারা কর্তৃপক্ষ। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কার্ডিও পালমোরিক ফেইলিউর’, ‘হেমোরেজিক শকড’।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘হেমোরেজিক শকড’ অর্থ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং ‘কার্ডিও পালমোরিক ফেইলিউর’ অর্থ আকস্মিক হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া।

বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক বলেন, রেজাউলকে ৩০ ডিসেম্বর কারাগারে পাঠানো হয়। তখন জেলে চিকিৎসক তাঁকে দেখে কিছুটা অসুস্থ মনে করে কারা হাসপাতালে পাঠান। তাঁকে কারাগারে পাঠানোর চিঠিতে (ফরোয়ার্ডিং) পায়ের কুঁচকিতে জখম আছে বলে উল্লেখ ছিল। ১ জানুয়ারি তাঁর পায়ের আর্টারি (ধমনি) থেকে রক্তপাত শুরু হলে তাঁকে শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠনো হয় এবং আত্মীয়স্বজনকে খবর দেওয়া হয়।

গ্রেপ্তারের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছেলের মৃত্যুর খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন রেজাউলের বাবা। শনিবার রাতে
ছবি:প্রথম আলো

নিহত রেজাউলের বাবা ইউনুস মুনসি বলেন, ঘটনার দিন রেজাউলকে আটকের খবর পেয়ে তিনি সেখানে যান। এরপর তিনি ছেলেকে আটক করার কারণ জানতে চান। কিন্তু এসআই মহিউদ্দিন কিছু না বলে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে রেজাউলকে নিয়ে যান। তখন রেজাউল সুস্থ ছিলেন। পরে তিনি জানতে পারেন, রেজাউলকে গাঁজাসহ আটক করা হয়েছে। এরপর গত শুক্রবার রাত নয়টার দিকে তাঁকে পুলিশের পক্ষ থেকে ফোন করে জানানো হয়, রেজাউল বাথরুমে পড়ে গেছেন এবং তাঁর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ জন্য তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে রেজাউলের সঙ্গে পরিবারের কাউকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশের নির্যাতনের কারণেই তাঁর ছেলের মৃত্যু হয়েছে।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, রেজাউল নামের ওই যুবক ২০১৯ সালে মাদক নিয়ে ধরা পড়েছিলেন। তিনি মাদক মামলার তালিকাভুক্ত আসামি ও মাদকাসক্ত। তাঁকে গ্রেপ্তার করে স্বাভাবিকভাবেই জেলখানায় পাঠানো হয়েছিল। যেহেতু তিনি মাদকাসক্ত, এ জন্য তাঁর কিছুটা অসুস্থতা ছিল। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ করা হলে উপপুলিশ কমিশনারকে (দক্ষিণ) প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বাকির হোসেন বলেন, রেজাউলকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তাঁর দুই পায়ের মধ্য দিয়ে রক্তক্ষরণ থামানো যাচ্ছিল না। তাঁকে রক্তও দেওয়া হয়েছিল, কিন্ত বাঁচানো যায়নি। মূলত অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্ত ছাড়া মৃত্যুর কারণ নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।