ঘর পেয়ে চোখে–মুখে আনন্দের ঝিলিক

রংপুরের তারাগঞ্জের ঘনিরামপুর গুচ্ছগ্রামে ঠাঁই হয়েছে এ অসহায় ভূমিহীন নারীদের পরিবারের
প্রথম আলো

কয়েক দিন আগেও রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার বনপাড়া গ্রামের ময়না খাতুনের (৪৮) ঘর ছিল না। এখন নিজের ঘর, জমি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় জমিসহ ঘরের মালিক হয়েছেন। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে তাঁর মতো উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ১৫০টি পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে। আরও ৫০টির কাজ শেষ পর্যায়ে।

ফরিদাবাদ গ্রামের স্বামীহারা মাহিয়া বেগমের (৫৫) চোখে–মুখেও আনন্দের ঝিলিক। তিনিও ফরিদাবাদ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ও জমি পেয়েছেন। এক যুগ ধরে খড়ের ছাউনি ও বাঁশের বেড়া দিয়ে ফরিদাবাদ মসজিদের পাশে পুরোনো ভাঙা ঘরে থাকতেন মহিয়া ও তাঁর দুই মেয়ে রেবেকা বেগম, নার্গিস খাতুন। স্বামী মারা যাওয়ার পর এ বাড়ি–ও বাড়ি কাজ করে খাবার জোগাতেন। কাজ পেলে খাবার জুটত, না হলে অনাহারে দিন কাটত।

মাহিয়া বলেন, ‘বাবা মোর সংসারোত কোনো ছেলে নাই। দুকনা মেয়ে। মুই ফরিদাবাদ গ্রামের মিস্টারের জমিত পলিথিন দিয়া চালা তুলি আছনু। আগোত দ্যাওয়ার পানি আইলে মুই রাইতোত নিন পাইড়ার পাও নাই। ভাঙা দিয়্যা পানি ঢুকি গাও বিছনা ভিজি গেছলো। সারা রাইত চেতন আছনু। এ্যালা দ্যাওয়ার পানি আইলেও মোর কোনো চিন্তা নাই। নয়া দালান ঘরোত থাকিম। এই ঘর কোনা না পাইলে এ জীবনে নয়া দালান ঘরোত শুতি থাকার আশা মনোতে থাকি গেল হয়।’

শ্যামগঞ্জ গ্রামের আবদুল জব্বার ৭৭ বছর পেরিয়েছেন। চোখে ঝাপসা দেখেন, চলেন লাঠিতে ভর দিয়ে। নেই কোনো সহায়–সম্পদ। স্ত্রী ফাতেমা বেগম ভিক্ষা পেলে খাবার জোটে না পেলে অনাহারে দিন কাটে। শ্যামগঞ্জ ক্যানেলের ধারে পলিথিন দিয়ে খুপরি ঘরে কষ্টে জীবন যাপন করতেন। তাঁকেও ফরিদাবাদ আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে।

নতুন পাকা ঘরের সামনে জব্বার দুহাত তুলে দোয়া করেন, ‘মুই তো চলিবারে পাও না। বউয়ে যা আনে তাকে খাও। ভাঙা ঘরোত এদ্দিন আছনু। আল্লাহ দিছে এলা নিজের পাকা ঘর হইল, জমি পানু, পায়খানা হইল। এলা আর মোর কোনো কষ্ট হইবে না। শান্তিতে ঘুমবার পাইম। তোমরা শেখের বেটিক কন, মুই যদ্দিন বাঁচিম তদ্দিন ওর তকনে দোয়া করিম। ওয় ঘর বানে না দিলে মোক রাস্তার ধারোতে থাকির নাগিল হয়।’

আজ শনিবার সরেজমিন ঘনিরামপুর, শুকানদীঘি, উজিয়াল, ফরিদাবাদ আশ্রয়-২ প্রকল্প ঘুরে দেখা গেল, গুচ্ছাকারে ঘরগুলো নির্মাণের করা হয়েছে। দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘরের সঙ্গে একটি রান্নাঘর, একটি সংযুক্ত টয়লেট। দেখে যেন মনে হয় পরিপাটি সাজানো ছবির মতো গ্রাম। এখানে চারটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২০০টি পরিবারের ঠাঁই হবে। ইতিমধ্যে ঘনিরামপুর গুচ্ছগ্রামে ৫১টি, শুকানদীঘি গুচ্ছগ্রামে ২৬টি, উজিয়াল গুচ্ছগ্রামে ৩৩টি, ফরিদাবাদ গুচ্ছগ্রামে ৪০টি পরিবারকে জমিসহ ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফরিদাবাদ গুচ্ছগ্রামে আরও ৫০টি ঘর নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে।

শুকানদীঘির আবদুর রাজ্জাক ও তাঁর স্ত্রী ফুলবানু বরাদ্দ পাওয়া শুকানদীঘি গুচ্ছগ্রামের নতুন ঘরের সামনে কথা বলার একপর্যায়ে রাজ্জাকের চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি বলেন, ‘এদ্দিন তো মোর থাকার খুবই কষ্ট আছলো। ইউএনও স্যার মোক পাকা ঘরোত ঢুকি দিছে। এ্যালা নয়া ঘরোত শান্তিতে ঘুমাইম।’

ঘনিরামপুর গুচ্ছগ্রামের বরাদ্দ পাওয়া পাকা ঘরের বারান্দায় বসে আছেন আছমা খাতুন (৫৫)। তিনি জানান, তাঁর স্বামী আবদুর রহমান ২০ বছর আগে মারা যান। ছেলে নেই। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আরেক মেয়ে তাঁর সঙ্গে থাকেন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে অতিকষ্টে চলত তাঁর জীবন। কথা বলার একপর্যায়ে আছমার চোখ গড়িয়ে পড়ে পানি। সেই চোখের পানি মুচতে মুচতে বলেন, ‘আগোত দ্যাওয়ার পানি আসলে মুই রাইতো ঘুম যাবার পাও নাই। ভাঙা দিয়া পানি ঢুকি গাও ভিজি গেছলো। মুই কোনো দিন ভাবো নাই নয়া ঘর পাইম। মোর মনে হওছে এটা যেন স্বপ্নে পাওয়া ঘর।’

সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আজম ও কুর্শা ইউপির চেয়ারম্যান আফজালুল হক জানান, আশ্রয়ণ চারটি প্রকল্পে আশ্রয় পাওয়া সবাই ভূমিহীন, দিনমজুর, ভিক্ষুক। তাঁদের পাকা ঘর করার সামর্থ্য ছিল না। ঘর পেয়ে দরিদ্র মানুষেরা খুবই খুশি।

জানতে চাইলে ইউএনও আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য ১ লাখ ৭১ হাজার করে টাকা ব্যয় হয়েছে। এই কাজ করতে জেলা প্রশাসক আসিব আহসান স্যার আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। যাঁরা ঘর পেয়েছেন, তাঁদের মুখের হাসি আমাকে মুগ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে।’

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান বলেন, মমতাময়ী মা জননেত্রী শেখ হাসিনার ব্যতিক্রমী উদ্যোগের ফলে তারাগঞ্জে ১৫০টি আশ্রয়হীন পরিবার আশ্রয় পেয়েছে। ঘরের চাবি ও জমির দলিল বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১০ দিনের মধ্যে আরও ৫০টি ভূমিহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হবে।