ঘরে এল প্রথম সন্তান, বাবা ফিরলেন লাশ হয়ে

বগুড়ার ধুনটে আজ বৃহস্পতিবার সকালে ধানখেত থেকে এক ইজিবাইকচালকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। লাশ উদ্ধারের আগে প্রায় ৪০ ঘণ্টা ধরে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। এদিকে গতকাল ওই ইজিবাইকচালকের ঘর আলো করে এসেছে প্রথম সন্তান। সন্তানের মুখ দেখার আগেই দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে লাশ হয়েছেন তিনি। তাঁর হত্যাকারী শনাক্ত হয়েছে নাটকীয়তার মোড়কে।

ধান খেতে ইজিবাইকচালক মিনহাজ আলী শেখের লাশ পড়ে রয়েছে শুনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সকালে গ্রামের নারী-পুরুষ জমায়েত হয় খেতের পাশে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে বগুড়ার ধুনটে জোড়গাছা গ্রামের স্কুলের মাঠেপ্রথম আলো

ইজিবাইকচালক মিনহাজ আলী শেখের (২৩) মনে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। বছর দেড়েক আগে বিয়ে করেছেন পাশের গ্রামে। স্ত্রী মনোয়ারা গৃহনিপুণা এবং সংসারের সবার খেয়াল রাখেন, ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন তিনি। বিয়ের পর থেকেই তরুণ মিনহাজ স্বপ্ন বোনেন, তাঁর ঘর আলো করে আসবে সন্তান। বাবা ডাকে তাঁকে ব্যাকুল করে রাখবে। পেটের দায়ে ইজিবাইক চালানোর সব ক্লান্তি তিনি ভুলে যাবেন বাড়ি ফিরে সেই ডাক শুনে।

মিনহাজের সেই স্বপ্ন অবশেষে সত্যি হয়। ঘরে অতিথি আসছে ‘সুখবর’ শোনান তাঁর জীবনসঙ্গী। সেই থেকেই মিনহাজের মনে শুধু আনন্দই। মনের খুশির পরশ পেতেন তাঁর ইজিবাইকে ওঠা যাত্রীরাও। আর মিনহাজ ইজিবাইক চালাতেন অনাগত সন্তান, স্ত্রী আর মাকে নিয়ে সুখে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে।

নিহত তরুণ ইজিবাইকচালক মিনহাজ আলী শেখ
সংগৃহীত

মিনহাজের সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায়। স্ত্রী মনোয়ারা খাতুনের কোল আলো করে এসেছে একটি পুত্রসন্তান। কিন্তু প্রথমবারের জন্য সন্তানকে কোলে তুলে সারা বাড়ি মাতিয়ে দেবেন যে বাবা, সেই মিনহাজ আগের দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে তাঁর ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকটি নিয়ে বেড়িয়ে তখনো বাড়ি ফেরেননি। মাঝখানে কেটেছে ২৪ ঘণ্টা। মিনহাজের খোঁজ না পেয়ে তাঁর স্ত্রী, মা, শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিশেহারা। অবশেষে মিনহাজের খোঁজ মিলেছে আজ বৃহস্পতিবার সকালে। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার জোড়গাছা গ্রামের ধানখেত থেকে সকাল ১০টার দিকে মিনহাজের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আকাঙ্ক্ষিত সন্তানের মুখ আর দেখা হয়নি তাঁর।

মিনহাজের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার চৌকিবাড়ি ইউনিয়নের বিশ্বহরিগাছা গ্রামে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মোজদার আলীর ছেলে মিনহাজ আলী দেড় বছর আগে পাশের চানদিয়ার গ্রামের আজাহার আলীর মেয়ে বিলকিস খাতুনকে বিয়ে করেন। এই প্রথম তাঁদের ঘরে সন্তান আসবে, সেই সন্তান প্রসবের জন্য বিলকিস খাতুন গত কয়েক দিন হলো শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন। এই অবস্থায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে বহালগাছা গ্রামের আবদুল মান্নানের ছেলে ফজলে রাব্বী (২৪) মিনহাজ আলীকে মুঠোফোনে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তাঁর ইজিবাইকে মির্জাপুর বাজারের দিকে রওনা হন। এরপর থেকে মিনহাজ আলীর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় গতকাল সন্ধ্যায় মিনহাজ আলীর স্ত্রী বিলকিস খাতুনের কোল আলো করে জন্ম নেয় এক পুত্রসন্তান।

সন্দেহভাজন হত্যাকারী গ্রেপ্তার

ট্র্যাজেডি ছাপিয়ে হত্যার ঘটনা নাটকীয়তায় ঠাসা। মিনহাজের সন্দেহভাজন হত্যাকারী হিসেবে যাত্রী বেশে মিনহাজকে ডেকে নেওয়া সেই ফজলে রাব্বীকেই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আর পরে তাঁর স্বীকারোক্তিমতেই মিনহাজের লাশের সন্ধান মিলেছে।

পুলিশ জানায়, ফজলে রাব্বী মিনহাজকে কুপিয়ে হত্যা করে ইজিবাইক ছিনিয়ে নিয়ে যান। সেই ইজিবাইক বিক্রি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন তিনি। পরে গতকাল সকালে সুঘাট ইউনিয়নের আওলাকান্দি গ্রামের রাস্তায় ইজিবাইকটি পড়ে থাকতে দেখে সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান থানায় খবর দেন। পুলিশ গিয়ে ইজিবাইকটি থানায় নিয়ে আসে। এ ঘটনার সঙ্গে মিনহাজ নিখোঁজের ঘটনায় পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়েছে দেখে ফজলে রাব্বী গতকাল বিকেলে নিজেই শেরপুর থানায় হাজির হন। থানায় গিয়ে তিনি পুলিশের সামনে ‘ছিনতাই নাটক’ সাজান। বলেন, মঙ্গলবার রাতে তিনি মিনহাজের ইজিবাইকের যাত্রী ছিলেন। রাতে জোরগাছা গ্রামের কাছে ছিনতাইকারীরা চালক মিনহাজকে ছুরিকাঘাত করে ইজিবাইকসহ চালক মিনহাজকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে।

তবে ফজলে রাব্বীর বর্ণনা অসংগতিপূর্ণ ঠেকায় এবং তাঁর পায়ের তালুতে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়। এ সময় তাঁকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি মিনহাজকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে আজ সকালে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে জোড়গাছা গ্রামের ধানখেত থেকে মিনহাজের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

আটক ফজলে রাব্বীকে সঙ্গে নিয়ে ইজিবাইকচালক মিনহাজ আলী শেখের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার সকালে বগুড়ার শেরপুরের জোড়গাছা গ্রামে
প্রথম আলো

মিনহাজ আলীর মা মনোয়ারা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। ছেলে পেটের দায়ে অটো (ইজিবাইক) চালাত। ছেলের ঘরে প্রথম সন্তান আসবে। তাই আমার ছেলের অটো চালাতে মনে কোনো কষ্ট ছিল না। খুনিরা তাকে তার ছেলের মুখটা পর্যন্ত দেখতে দিল না...।’

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গাজিউর রহমান বলেন, ফজলে রাব্বী ইজিবাইক ছিনতাই করতেই মিনহাজকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাতে খুন করেন। পরে ইজিবাইক বিক্রি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তিনি নিজেই থানায় এসে ইজিবাইকচালককে অপহরণ ও ছিনতাইয়ের নাটক সাজানোর চেষ্টা করেন। এ সময় তাঁর অসংগতিপূর্ণ কথাবার্তা ও পায়ে ছুরির আঘাত থাকায় তাঁকে আটক করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি নিজেই খুনের কথা স্বীকার করেন। তাঁর তথ্য মোতাবেক লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছে কি না, সে বিষয়ে জানতে আরও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মামলা করা হবে।