ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো, পাকা হয়েছে রাস্তাঘাট

২০১৫ সালের ১ আগস্ট ছিটমহল বিনিময় হয়। দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দাবি বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর।

ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো, পাকা হয়েছে রাস্তাঘাট, গড়ে উঠেছে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিটি পরিবার ব্যবহার করছে উন্নত মানের শৌচাগারসহ নলকূপ। চিকিৎসাসেবার জন্য গড়ে উঠেছে কমিউনিটি ক্লিনিক। জমির মালিকানাও পেয়েছেন বাসিন্দারা।

এমন চিত্র এখন নীলফামারী ও পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে। দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসানের ৬ বছরের মাথায় বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের জীবনযাপন। আজ রোববার এই ছিটমহল বিনিময়ের ছয় বছর পূর্তি। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট ছিটমহল বিনিময় হয়। দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দাবি বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর।

পঞ্চগড়ের তিনটি উপজেলায় (সদর, বোদা ও দেবীগঞ্জ) ৩৬টি ছিটমহলের মধ্যে ১৭টিতে জনবসতি রয়েছে। আর নীলফামারীর ডিমলায় বিলুপ্ত ছিটমহলের সংখ্যা চার। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মাধ্যমে ১২০ দশমিক ২৯ কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণ, ৫৫৯ দশমিক ২৪ মিটার ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি, ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার খাল খনন, ৫টি হাটে শেড স্থাপন, ১৩টি মসজিদ, ৮টি মন্দির, তিনটি কমিউনিটি সেন্টার, দুটি ঘাট, তিনটি কবরস্থান নির্মাণ করা হয়েছে। এতে প্রায় ১০৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

নাগরিকত্বের পরিচয় নিশ্চিত করতে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য পাঁচটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। আর বেসরকারি পর্যায়ে ১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩টি কলেজ গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার সভাপতি মফিজার রহমান বলেন, ছিটমহল বিনিময়ের বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে দিবসটিকে ‘ছিটমহল স্বাধীনতা’ অথবা ‘বিনিময় দিবস’ হিসেবে জাতীয় দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তাঁর।

* পঞ্চগড়ের ৩ উপজেলার ১৭ বিলুপ্ত ছিটমহলে জনবসতি আছে। নীলফামারীর ডিমলায় এ সংখ্যা চার। * স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে গড়ে উঠেছে কমিউনিটি ক্লিনিক, পাকা হয়েছে রাস্তা। * ডিমলায় ১৫৭টি পরিবার পেয়েছে বিদ্যুৎ-সংযোগ। অনেকের বাড়িতে আছে সোলার প্যানেল।

গত শনিবার নীলফামারীর ডিমলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের নগর জিগাবাড়ি (সাবেক আজোয়ারপাড়া) গ্রামে গিয়ে কথা হয় মর্জিনা খাতুনের (৪৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁদের প্রধান দাবি ছিল বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। এখন বাড়ির সামনে পাকা সড়ক হয়েছে, বিদ্যুৎ-সংযোগ এসেছে। আগে সন্তানদের মিথ্যা পরিচয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে হতো। এখন নিজ পরিচয়ে ভর্তি করানো যাচ্ছে।

গ্রামের রাসেল ইসলাম (২৫) বলেন, ‘সে সময়ে ঠিকানা চুরি করে হলেও কষ্ট করে কিছুটা লেখাপড়া শিখেছি। এখন নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পেয়েছি। সে স্বীকৃতিতে সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগে চাকরির সুযোগ হয়েছে।’

ডিমলার বিলুপ্ত ৪ ছিটমহলে ১৫৭টি পরিবার পেয়েছে বিদ্যুৎ-সংযোগ। অনেকের ঘরে দেখা গেছে সোলার প্যানেল। ওই চার ছিটমহলের জন্য রহমানগঞ্জ বাজারে স্থাপিত হয়েছে ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্র। কেন্দ্রটিতে বিভিন্ন প্রয়োজনে এলাকার মানুষের আনাগোনাও রয়েছে। নগর জিগাবাড়িতে কমিউনিটি সেন্টারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহল লাগোয়া গয়াবাড়ি ইউনিয়নের রহমানগঞ্জ বাজারে ডিজিটাল কেন্দ্রের উদ্যোক্তা আবদুল আলীম জানান, কেন্দ্র থেকে মুঠোফোনে টাকা লেনদেন, তথ্য আদান-প্রদান, ছবি তোলা, ফটোকপিসহ নানা সুবিধা পান বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। কেন্দ্রটি স্থাপনে সহযোগিতা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রানী রায় বলেন, বিলুপ্ত চার ছিটমহলের বেশির ভাগ রাস্তা, সেতু-কালভার্টের কাজ শেষ হয়েছে। যতটুকু বাকি আছে, তা-ও দ্রুত শেষ করা হবে। জিগাবাড়ি গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৪-এর স্থলসীমান্ত চুক্তি (মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি) বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যে বিনিময় হয় ১৬২টি ছিটমহলের। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের ভূখণ্ড হয়ে যায়। এতে অবসান ঘটে দীর্ঘদিনের মানবিক সমস্যার।