ঘরে ফিরতে ধোয়ামোছা শুরু করেছেন সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিতরা
সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগর এলাকার বাসিন্দা বিষ্ণু দাস (৫২)। বন্যার পানিতে ঘর তলিয়ে যাওয়ার পর পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সড়কের পাশের একটি বিপণিবিতানের দোতলায়। ঘর থেকে পানি নামায় স্ত্রী দিপালী দাস, দুই মেয়ে বৃষ্টি দাস ও জয়া দাসকে নিয়ে আজ শুক্রবার সকালে বাড়িতে এসেছেন।
উঠানে এখনো হাঁটুপানি। ঘরের ভেতরের সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। পানিতে ভিজে আছে সব আসবাব। বিছানাপত্র সব ভেজা। বৃষ্টি ও জয়ার সব বইপত্রও পানিতে নষ্ট হয়েছে। এক সপ্তাহ এগুলো পানির নিচে ছিল। দুই বোন উঠান থেকে পানি নিয়ে ঘরের মেঝে, আসবাব ধুয়েমুছে পরিষ্কার করছিলেন।
দিপালী দাস বলেন, ‘আজ আসা যাইত না। আরও এক দিন দোকানে থাকতে অইব। ঘরও গন্ধ করে। এর লাগি এক দিন পরে আইমু।’
বিষ্ণু দাস বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। একটি করাতকলে কাজ করি। এখন মিলটাও বন্ধ। ঘরের যেসব জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে, সেগুলো আবার এখন কেনার মতো অবস্থা নাই।’
সুনামগঞ্জে শুক্রবার বৃষ্টি হয়নি। তার বদলে সকাল থেকে রোদ উঠেছে। পানি আরও কমেছে। অনেক বাড়িঘর থেকে পানি নেমেছে। স্কুল-কলেজ ও অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া লোকজন বাড়িতে গিয়ে ধোয়ামোছা ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। ঘর প্রস্তুত করছেন আবার ফেরার জন্য। তবে সুনামগঞ্জ শহরের বেশ কিছু এলাকায় এখনো মানুষের বাড়িঘরে পানি আছে। কিছু কিছু রাস্তাঘাট থেকে এখনো পানি নামেনি। এসব এলাকার মানুষদের ঘরে ফিরতে আরও দু-চার দিন সময় লাগবে।
শহরের প্রতিটি এলাকাতেই পানি কিছুটা কমায় মানুষজন নিজের ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেকেই ফিরেছেন। শহরের সুলতানপুর এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন (৪০) বলেন, তাঁরা ফিরতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। তাঁদের এলাকাটি নিচু। এখনো মানুষের বাড়িঘরে পানি আছে। এই গ্রামের বেশির ভাগ লোকই আছেন সরকারি কলেজে।
শহরের হাসননগর, মোহাম্মদপুর, ওয়েজখালি, কালীপুর, হসনবসত, বড়পাড়া, তেঘারিয়া, পাঠনবাড়ি, মরাটিলা, মল্লিকপুর এলাকায় এখনো পানি আছে। হাসননগর এলাকার বাসিন্দা হেলাল মিয়া পরিবার নিয়ে আছেন সুনামগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। তিনি জানান, তাঁর ঘর থেকে এখনো পানি নামেনি। মাটির ঘর। পানি নামার পর দু–এক দিন যাবে মাটির মেঝে শুকাতে শুকাতে। এরপরই তাঁরা ফিরবেন।
নবীনগর এলাকার আবদুস সামাদ ও মোহিতা বেগম দম্পতি এখন ঘরের আসবাব ধোয়ামোছার কাজে ব্যস্ত। তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন এলাকায় থাকা যুব উন্নয়ন কার্যালয়ের একটি ভবনে। সেখানে আরও অনেক পরিবার আছে। আবদুস সামাদ বলেন, ঘরের ভেতর বুকসমান পানি ছিল। কোনোরকমে দুই ছেলেসহ ঘর থেকে সাঁতরে সড়কে উঠেছিলেন। কোনো জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারেননি। সব পানিতে নষ্ট হয়েছে।
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা অনিমা বর্মণের (৩৫) ঘরের দুয়ারে এখনো বন্যার পানি। শুধু ঘর থেকে নেমেছে। দুয়ারে বসেই থালাবাসন পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করছিলেন। ভেতরে নিয়ে দেখালেন, ঘরের আসবাবের বেহাল দশা। যাওয়ার সময় ফ্রিজটা শুধু খাটের ওপর তুলে গিয়েছিলেন। সেটিও রক্ষা পায়নি। তাঁরা পরিবার নিয়ে এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের ভবনে আছেন। অনিমা বলেন, স্বামী সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান। অনেক কষ্টে টাকা সঞ্চয় করে ফ্রিজটা কিনেছিলেন। এটি আবার কাজ করবে কি না, বুঝতে পারছেন না।
১৬ জুন রাত থেকে এসব মানুষ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউ অন্যের বাড়ি, হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি ভবনে উঠেছেন। সেদিন হঠাৎ করেই ব্যাপক পরিমাণে বন্যার পানি আসায় পুরো শহরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। শহরে কয়েক ঘণ্টায় পাঁচ থেকে সাত ফুট পানি দেখা দেয়। তখন মানুষজন যে যেখানে পারেন, আশ্রয় নিয়েছেন। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। পানি নামছে। তবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মানুষের ঘরবাড়ি ও আসবাবের। অনেকের জিনিসপত্র ভেসে গেছে বন্যার পানিতে।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেছেন, পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা শ্রমজীবী মানুষেরা আছেন বেশি সমস্যায়। অনেকে ঘর নিচু এলাকায়। আবার কারও কারও ঘর বেশি ক্ষতি হওয়ায় ফিরতে সমস্যা হচ্ছে।