‘ঘাতকের ছুরির আঘাতে স্বপ্নবাজ ভাইটার স্বপ্ন ভেসে গেল’

দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম বিশু মিয়ার। ছোটবেলা থেকেই তাঁরা (তিনি ও দুই বোন) দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে ভাগ্য পরিবর্তনের। ইতিমধ্যে তিনি ও  তাঁর এক বোন বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। অন্য ছোট বোনকেও একই কলেজে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি করেন।

দেড় বছর আগে বাবা জাহিদুল ইসলামের মৃত্যুর পর গোটা সংসারের দায়িত্ব পরিবারের একমাত্র ছেলে বিশু মিয়ার কাঁধে এসে পড়ে। সরকারি চাকরির আশায় বিসিএস পরীক্ষাসহ নানা দপ্তরে একের পর এক নিয়োগ পরীক্ষা দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যাশিয়ার পদে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অপেক্ষমাণ তালিকায়ও ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁদের পরিবারে গত রোববার কালো মেঘের ছায়া নেমে আসে। এদিন বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ ক্যাম্পাসে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ দিতে হয় তাঁকে।

বিশুর বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামে। পরিবারের একমাত্র ছেলে বিশুকে হারিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে তাঁদের পরিবার। বাকরুদ্ধ স্বজনেরা। ছোট বোন জাহানারা খাতুন বলেন, ‘শৈশব থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছি আমরা। আমার ভাইয়ের খুব স্বপ্ন ছিল, সরকারি একটা চাকরি জুটলেই দুই বোনকে ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন। সংসারে অভাব ঘোচাবেন। কিন্তু ভাইয়ার সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। ঘাতকের ছুরির আঘাতে স্বপ্নবাজ ভাইটার স্বপ্ন ভেসে গেল। তাঁকে হারিয়ে গোটা পরিবারে শূন্যতা আর অনিশ্চয়তার অন্ধকার নেমে এল।’

জাহানারা খাতুন বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব চাপে ভাইয়ার কাঁধে। সংসারের খরচ ও আমাদের দুই বোনের পড়াশোনার খরচ জোগাতে তিনি একটি বেসরকারি অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন চাকরিও করেন। মেসে থেকে ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করতেন। ভালো বেতনও পেতেন। সেই বেতনের টাকায় দুই বোনের পড়াশোনার খরচ, তাঁর এবং আমাদের মেসের খরচ শেষেও মায়ের হাতে প্রতি মাসে কিছু অর্থ তুলে দিতেন। কিন্তু সেখানে সব সময় ঋণ আদায়ের প্রচণ্ড চাপে থাকতে হতো। এতে সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছিল। অর্থকষ্ট হবে জেনেও শেষ পর্যন্ত কয়েক দিন আগে চাকরিটা ছেড়ে দেন। ৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সরকারি নানা দপ্তরে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। অনেক দপ্তরে বিভিন্ন পদে আবেদন করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষার ফলাফলে অপেক্ষমাণ তালিকাতেও নাম আছে তাঁর। আত্মবিশ্বাস ছিল, বিসিএস বা অন্য কোনো সরকারি চাকরি পেয়েই যাবেন তিনি। কিন্তু তা আর হলো না।’

জাহানারা খাতুন বলেন, ‘সোমবার থেকে গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণা শুনে রোববার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে মেসের উদ্দেশে বের হন। সঙ্গে দুই ভাইবোনের মেসের খরচের চার হাজার টাকা সঙ্গে ছিল তাঁর। রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলি। এ সময় কলেজ ক্যাম্পাসের আখতার আলী মুন হলের সামনে দিয়ে হেঁটে মেসে যাওয়ার কথা জানান। ১০ মিনিট পর তাঁর লাশ পড়ে থাকার খবর পাই।’ তিনি বলেন, তাঁকে হত্যার ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। এটা নিছক ছিনতাই হলে টাকাপয়সা, মুঠোফোন সবই খোয়া যেত। কিন্তু ঘাতকেরা কিছুই নেয়নি। কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতাও ছিল না। তবু মনে হচ্ছে, তাঁকে পরিকল্পিতভাবে কেউ খুন করেছে।
স্বজনেরা জানান, রোববার রাত নয়টার দিকে কলেজের শহীদ আখতার আলী মুন হলের সামনে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান বিশু মিয়া। তিনি সরকারি আজিজুল হক কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করে কলেজসংলগ্ন জামিলনগর এলাকার একটি ছাত্রাবাসে থেকে চাকরি খুঁজছিলেন।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রান্তিক কৃষক জাহিদুলের বসতভিটা আর বিঘাখানেক আবাদি জমিই সম্বল। চাষাবাদ করে কোনোরকমে সংসার চালাতেন তিনি। অনেক কষ্ট করে একমাত্র ছেলে বিশু এবং দুই মেয়ে জাহানারা ও জাকিয়ার পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। দেড় বছর আগে জাহিদুল মারা গেলে তিন ভাইবোনের পড়াশোনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

মা হেলেনা বেগম বলেন, তিন ছেলেমেয়েই সরকারি আজিজুল হক কলেজে পড়াশোনা করেছেন। এর মধ্যে সবার বড় বিশু হিসাববিজ্ঞান এবং বড় মেয়ে জাহানারা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। ছোট মেয়ে জাকিয়া পড়ছেন ইসলামের ইতিহাস বিভাগে।

বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশু মিয়ার প্যান্টের পকেটে থাকা মানিব্যাগে চার হাজার টাকা ও দুটি মুঠোফোন অক্ষত ছিল। এতে এটা নিছক ছিনতাই থেকে ঘটেছে, সেটা বলা যাবে না। খুনের পেছনের কারণ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই খুনের মোটিভ অজানা। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করাও সম্ভব হয়নি।