ঘাস চাষে ভাগ্য বদল

তারাগঞ্জের বুড়িরহাট বাজারে চলছে ঘাস বেচাকেনা। ছবিটি গতকাল মঙ্গলবার তারাগঞ্জ-বুড়িরহাট রাস্তার পাশ থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
তারাগঞ্জের বুড়িরহাট বাজারে চলছে ঘাস বেচাকেনা। ছবিটি গতকাল মঙ্গলবার তারাগঞ্জ-বুড়িরহাট রাস্তার পাশ থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

মিলন রহমানের (৩৬) সাত বছর আগের জীবনের সঙ্গে এখন কোনো মিল নেই। ওই সময় তাঁর বসতভিটা ছাড়া কোনো জমি ছিল না। অন্যের জমিতে কামলা খেটে কোনোরকমে সংসার চালাতেন। একবেলা খাবার জুটলেও আরেক বেলা জুটত না। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে প্রায় উপোস থাকতে হতো। আর আজ তিনি সফল ঘাসচাষি। পাকা বাড়ি, দেড় একর জমির মালিক।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর গ্রামের মিলন রহমানের ভাগ্যের চাকা বদলে গেছে ঘাস চাষে। এখন এলাকার অনেক ঘাসচাষির পথপ্রদর্শক তিনি।

উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সয়ার ইউনিয়নের দামোদরপুর গ্রাম। এই গ্রামে মিলন রহমানের বাড়ি। গ্রামটিতে ঢুকেই চোখে পড়ে সবুজের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ ঘাসের খেত। কেউ ঘাস কাটছেন, কেউ আঁটি বেঁধে রিকশায় করে বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। মিলনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি বাড়ির পাশে লাগানো জমির ঘাস কাটছেন। সাংবাদিক পরিচয় শুনে আইলে উঠে আসেন। এরপর ঘাস চাষের গল্প শোনান।
মিলনের ঘাস চাষের গল্প

চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় মিলন রহমান। ২০১০ সালে বদরগঞ্জ উপজেলার কালুপাড়া গ্রামের আনিছ হোসেনের মেয়ে নাছিমা আক্তারকে বিয়ে করেন। দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। কাজ পেলে খাবার জুটত, না পেলে অনাহারে থাকতে হতো। তাঁর কষ্ট দেখে শ্বশুর আনিছ হোসেন তাঁকে নেপিয়ার ঘাস চাষের পরামর্শ দেন।

মিলন রহমান সয়ার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আজমের ৩০ শতক জমি এক বছরের জন্য আট হাজার টাকায় বর্গা নিয়ে ঘাস লাগান। দেখতে দেখতে ঘাসের খেত সবুজে ভরে ওঠে। ৫০ দিনের মাথায় ঘাস বিক্রি করে খরচ বাদে সাত হাজার টাকা আয় আসে। এরপর আরও ৮০ শতক জমি বর্গা নিয়ে ঘাস চাষে লেগে পড়েন। স্ত্রীও তাঁর সঙ্গে কাজে হাত লাগান।

এভাবে একপর্যায়ে মিলন রহমান হয়ে ওঠেন সফল ঘাসচাষি। কেনেন দেড় একর জমি, বানান পাকা বাড়ি। মাছ চাষের জন্য খনন করেন পুকুর। দুটি গাভিও আছে। এখন ১ একর ৪০ শতক জমিতে করছেন ঘাসের চাষ। ঘাস বিক্রি করে খরচ বাদে বছরে আয় করছেন প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
ঘাস চাষ করে মিলন শুধু নিজের ভাগ্যই বদল করেননি। গ্রামের অনেককেই পরামর্শ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন।

মিলনের মতো তাঁদেরও ভাগ্য বদল
পাঁচ বছর আগে গ্রামের রেজাউল ইসলামকে সবাই দিনমজুর হিসেবে চিনতেন। তাঁর সহায়-সম্বল বলতে ছিল পাঁচ শতক জমির ওপর ছোট্ট একটা টিনের ঘর। এলাকায় কাজ না থাকায় আশ্বিন-কার্তিক মাসে তাঁর পরিবারকে প্রায় উপোস থাকতে হতো। কিন্তু এখন রেজাউলের ঘরে সারা বছর চাল থাকে। কামলাও খাটতে হয় না। অন্যের ২০ শতক জমি বর্গা নিয়ে ঘাস চাষ শুরু করে টিনের বাড়ি করেছেন। নিজের কেনা ৩০ শতক ও বন্ধক নেওয়া ৩০ শতক জমিতে এবার করেছেন ঘাসের চাষ। ৫০ দিনের মাথায় সেই জমির ঘাস কেটে বিক্রি করে খরচ বাদে আয় করেছেন ১৫ হাজার টাকা।

গ্রামের আরেক ঘাসচাষি আজিজুল ইসলাম বলেন, ঘাস চাষ তাঁর জীবনে সচ্ছলতা এনে দিয়েছে। আগে একবেলা খাবার জোগাড় করাই যেখানে দায় হয়ে যেত, সেখানে এখন খাওয়া-পরা বাদেও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ দিতে পারছেন তিনি।

তিন একর জমিতে ঘাস লাগিয়েছেন পাশের রহিমাপুর গ্রামের আদম হোসেন। তিনি বলেন, ধানের চেয়ে ঘাস চাষে লাভ তিন গুণ। বছরে এক একর জমিতে দুবার ধান চাষ করা যায়। এতে খরচ বাদে ধান বিক্রি করে বছরে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়। কিন্তু বছরের সাতবার খেত থেকে ঘাস কেটে বিক্রি করা যায়। এতে খরচ বাদ দিয়ে বছরে এক একর জমির ঘাস বিক্রি করে প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় করা যায়।

বৈদ্যনাথপুর গ্রামের আরেক কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, উঁচু মাটিতে এ ঘাসের চাষ ভালো হয়। একবার ঘাসের মুড়া লাগালে চার বছর পর্যন্ত ঘাস পাওয়া যায়। সারি থেকে সারির দূরত্ব সাড়ে ৩ থেকে ৪ ফুট করতে হয়। সারা বছর ঘাস লাগানো যায়। তবে বর্ষাকালে ঘাস লাগালে ভালো হয়। ঘাস লাগানোর সময় জমিতে প্রচুর গোবর সার দিতে হয়। ২০ দিন পর একরে ৫০ কেজি ইউরিয়া, ১৫ কেজি টিএসপি দিলে ৫০ দিনের মাথায় ঘাস কাটা যায়।

সয়ার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আজম বলেন, মিলন রহমান হলেন তারাগঞ্জের ঘাসচাষিদের মডেল। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সয়ার ইউনিয়নের অনেকেই ঘাস চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, দিন যত যাচ্ছে, তারাগঞ্জে নেপিয়ার ঘাসের চাষ ততই বাড়ছে। লাভ বেশি হওয়ায় ধান ছেড়ে অনেকে বাণিজ্যিকভাবে এ ঘাসের চাষ করছেন। এতে গো–খাদ্যের চাহিদাও পূরণ হচ্ছে। অন্যদিকে এলাকার অনেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।