ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন শেষ, মাথায় ঋণের বোঝা

এখানে দোকানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা এক লাখের মতো। গত বছরের রোজার ঈদের আগে তাঁরা বেতন-বোনাস পাননি। এবারও সম্ভাবনা নেই।

নেই চিরচেনা ব্যস্ততা, হাঁকডাক। ঈদ মৌসুমের বেচাবিক্রি বন্ধ। লকডাউনে তালা ঝুলছে পুরান ঢাকার ইসলামপুরের পাইকারি কাপড়ের বাজারে। গতকাল দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

পুরান ঢাকার ইসলামপুরের বাবুলি স্টার সিটি কমপ্লেক্সে কাপড়ের দোকান বিসমিল্লাহ ফেব্রিকসের মালিক মুন্সিগঞ্জের শাহীন ব্যাপারী। করোনার প্রকোপে গত বছরে টানা ৬৬ দিন তাঁর দোকানটি বন্ধ ছিল। সেবার ঈদে কোনো বেচাকেনা করতে পারেননি। তাই আশা করেছিলেন, এ বছর ঈদের আগে রমজান মাসজুড়ে বেচাকেনা হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পোশাক ব্যবসায়ীরা আবার ভিড় করবেন ইসলামপুরে। তাই একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে সম্প্রতি ২৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দোকানে নতুন কাপড় তোলেন। এবার ভালোভাবে বেচাকেনা করে গত বছরের আর্থিক ক্ষতিটা পুষিয়ে নেওয়ার আশায় ছিলেন তিনি। তবে ১৩ দিন আগে (৫ এপ্রিল) করোনায় আবার সরকারি বিধিনিষেধে দোকানপাট বন্ধের খবর শুনে হতাশ হয়ে পড়েন ব্যবসায়ী শাহীন। আর চলমান কঠোর লকডাউনে ঈদের আগে বেচাকেনার ভরা মৌসুমে দোকানপাট বন্ধ। অথচ গুদামে পড়ে আছে লাখ লাখ টাকার কাপড়। ঈদের আগে যদি আর দোকানপাট না খোলে, আর যদি বেচাকেনার সুযোগ না পান, তাহলে কীভাবে তিনি ব্যাংকের ঋণ শোধ দেবেন, সেই দুশ্চিন্তা তাঁকে ঘিরে ধরেছে। বাসায় অস্থির সময় কাটছে তাঁর।

শাহীন ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহু বছর ধরে ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা করছি। রমজান মাসজুড়ে মূলত বেচাকেনা হয়। ঈদের আগে সারা দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা ইসলামপুরে এসে কাপড় নিয়ে যান। এবারও বেচাকেনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে করোনায় লকডাউন শুরু হয়। দোকানপাট বন্ধ। এখন আমরা বিপদে আছি।’

করোনায় কঠোর লকডাউনে সরকারি–বেসরকারি অফিস, বাস, ট্রেন, লঞ্চ চলাচল বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেছে দেশের দোকানপাট, শপিং মল। দোকানে দোকানে ঝুলছে তালা।

ঈদের আগে বেচাকেনার মৌসুমে দোকানপাট বন্ধ থাকায় প্রত্যেক বস্ত্র ব্যবসায়ী আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। দিনের পর দিন দোকানপাট বন্ধ থাকায় গতবারের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে রূপ নিচ্ছে। বেচাকেনা যদি বন্ধ থাকে, তাহলে ব্যাংকঋণ, দেনাদারের পাওনা কীভাবে শোধ দেবেন, সেই চিন্তাই কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়।

ইসলামপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ীদের তথ্য বলছে, শুধু ইসলামপুরে পাইকারি কাপড়ের দোকানের সংখ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছি। দোকানের কর্মকর্তা–কর্মচারীর সংখ্যা এক লাখের মতো। গত বছরের রমজানের ঈদের আগে তাঁরা বেতন–বোনাস সেভাবে পাননি। ঈদের আগে যদি দোকানপাট না খোলে, তাহলে এ বছরও তাঁদের কীভাবে বেতন–বোনাস দেবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি পিসসহ যেকোনো ধরনের কাপড় উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে এখানকার অনেক মানুষ জড়িত। ডাইং, ওয়াশিং, প্রিন্টিং, প্যাকেজিংসহ নানা পদের মানুষের হাতের ছোঁয়ায় শেষ পর্যন্ত একটি কাপড় ভোক্তার ব্যবহারের উপযোগী হয়।

ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেসার উদ্দিন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার লকডাউনে ঈদের আগে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইসলামপুরের সব বস্ত্র ব্যবসায়ী কঠিন বিপদের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন। গত বছরও ঈদে কোনো ব্যবসা করতে পারিনি। তাই আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে যেভাবে পেরেছেন, ধারদেনা করে দোকানে নতুন কাপড় তুলেছেন। ঈদের আগে আবার দোকান বন্ধ, লাখ লাখ শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি পিসসহ নানা ধরনের কাপড় গোডাউনে পড়ে আছে। এই কাপড় যদি আমরা বিক্রি করতে না পারি, তাহলে আমাদের মতো পাইকারি বস্ত্র ব্যবসায়ীদের অনেকে পথে বসে যাবেন। আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না।’

কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে দোকানপাট খুলে দেওয়ার দাবি জানান ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির নেতা নেসার উদ্দিন।

দোকানে দোকানে তোলা

করোনার লকডাউনে সদরঘাট থেকে ইসলামপুরের প্রধান সড়কে ঢোকার পথে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া। তবে পুরান ঢাকার মিটফোর্ডের বাবুবাজার সেতুর নিচ দিয়ে ইসলামপুরের প্রধান সড়কে ঢোকা যায়। ইসলামপুরের কাপড়ের মার্কেটগুলোর প্রধান ফটক বন্ধ। দোকানে দোকানে ঝুলছে তালা। সেখানে বস্ত্র ব্যবসায়ীদের দেখা না মিললেও অনেক দোকানের সামনে কর্মচারীদের দেখা গেছে। তাঁদের চোখেমুখে হতাশার চিহ্ন।

ইসলামপুরের দৌলত কমপ্লেক্স মার্কেটের কর্মচারীদের সরদার আবদুল আওয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রমজান মাসজুড়ে ইসলামপুরের প্রতিটি দোকানের কর্মচারীরা ব্যস্ত থাকেন। অথচ করোনার লকডাউনে সব দোকান বন্ধ। বহু কর্মচারী কাজ হারিয়েছেন। অনেকে বাড়ি চলে গেছেন। বেকার হয়ে খুব খারাপ সময় কাটছে তাঁদের।’

ইসলামপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম। ইসলামপুরের গুলশান আরা সিটিতে ইউনিক কালেকশন নামের একটি দোকান আছে তাঁর। দোকানপাট বন্ধ থাকায় বাসায় দিন কাটছে তাঁর।

বস্ত্র ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুটি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ঈদের আগে নতুন কাপড় তুলেছি। দোকান বন্ধ। ঈদের আগে যদি বেচাকেনা না করতে পারি, তাহলে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই আমাদের দাবি, ঈদের আগে সরকার স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানার শর্তে দোকানপাট খুলে দেওয়ার অনুমতি দিক।’