চকরিয়ায় ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ১৯৫টি গ্রাম প্লাবিত, এক শিশুর মৃত্যু

ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সড়ক ডুবে গেছে। এলাকার বাসিন্দারা নৌকায় যাতায়াত করছেন। বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচরের বারআউলিয়া নগর এলাকায়
প্রথম আলো

ভারী বর্ষণে ও মাতামুহুরী নদী বেয়ে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভার ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে এসব গ্রামের লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পানিতে ডুবে মারা গেছে এক শিশু। গতকাল বুধবার বিকেল থেকে পৌর এলাকার গ্রামগুলো প্লাবিত হতে শুরু করে। জোয়ারের সময় পানি আরও বেড়ে যাচ্ছে। এর বাইরে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের আরও ১৬০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, চকরিয়া পৌর শহরের সব কটি সড়ক ডুবে গেছে। ভ্যান ও ট্রাকে করে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে। পৌর এলাকার বাসাবাড়িতে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি ঢুকে পড়েছে। কারও চুলায় আগুন জ্বলছে না। অনেকের আসবাব ডুবে গেছে। সড়কের ওপর অনেকে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। চকরিয়া থানা ও চকরিয়া উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে হাঁটুসমান পানি ঢুকেছে। পৌর শহরের অন্তত দেড় হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে আছে।

চকরিয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল করিম বলেন, তাঁর ওয়ার্ডের মৌলভীর চর, জালিয়াপাড়া ও শমসের পাড়া এলাকা ডুবে গেছে। জালিয়াপাড়া এলাকার অন্তত ৪০০ বসতঘরের চালা ডুবে গেছে। কিছু মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ির উঠানের পানিতে ডুবে মো. মারুফ (২) নামের এক শিশু মারা গেছে। সে মৌলভীরচর এলাকার নেজাম উদ্দিনের ছেলে।
৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বলেন, হিন্দুপাড়া এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে মাতামুহুরী নদীর পানি ঢুকছে। তবে পৌরসভার পক্ষ থেকে বালুর বস্তা ও মাটি দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

বসতঘরে পানি ঢোকায় দুর্ভোগে পড়েছে পৌরসভার বাসিন্দারা। বাটাখালী এলাকার বাসিন্দা দিদারুল ইসলাম বলেন, বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে ঘরের ভেতরে পানি ঢুকেছে। পরে পরিবারের সদস্যদের এক আত্মীয়ের পাঁচতলা বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন সব জায়গায় খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। ফুলতলা এলাকার বাসিন্দা মাহমুদা খানম বলেন, ‘বসতঘরে পানি ঢুকেছে। বুধবার রাত থেকে শিশুসন্তানদের নিয়ে পানিতেই থাকছি। ঘর ছেড়ে কোথাও গেলে চুরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। রাতে এক ব্যক্তি রান্না করা খাবার পাঠিয়েছিল। সকালে পাউরুটি খেয়েছি। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। দোকানপাটও বন্ধ।’

আরও পড়ুন

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, চকরিয়া পৌরসভার পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিমে মাতামুহুরী নদী রয়েছে। সেখানকার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে মাটি ও বালুর বস্তা দেওয়া হচ্ছে। মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। যাঁরা রান্না করতে পারছেন না, তাঁদের ঘরে খাবার পাঠানো হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে ১০ টন চাল, ১৫ বস্তা করে চিড়া ও গুড় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

পৌরসভার বাইরে নতুন করে আরও ৫৫টি গ্রাম প্লাবিত

বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চকরিয়া উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের ১০৫টি গ্রাম ভারী বর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে। বুধবার রাত থেকে আজ বেলা ৩টা পর্যন্ত নতুন করে আরও ৫৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের ১৬০টি গ্রাম এখন প্লাবিত। উপজেলার বিএম চর, কৈয়ারবিল, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, হারবাং, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, বদরখালী, পূর্ব বড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা, সাহারবিল, চিরিংগা, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী ও বমু বিলছড়ি ইউনিয়নে পানি বাড়ছে। কয়েকটি স্থানে গ্রামীণ সড়ক ও বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। কৃষি ও মৎস্য ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

ভারী বর্ষণে কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভার থানা সেন্টার এলাকায় কোমর সমান পানি। মানুষ ট্রাকে চেপে ছুটছেন। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে
প্রথম আলো

বিকেল চারটার দিকে লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের জিদ্দাবাজার এলাকায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক থেকে বার আউলিয়া নগর সড়ক ডুবে গেছে। স্থানীয় লোকজন নৌকায় করে নিরাপদ আশ্রয়ে পাড়ি দিচ্ছেন। অনেকে গৃহপালিত পশু গরু-ছাগল মহাসড়কের ধারে পলিথিনের ছাপরা টেনে বেঁধে রেখেছেন।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, নতুন করে উপজেলার আরও ৫৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সব স্থানে শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়ার উপসহকারী প্রকৌশলী জামাল মোর্শেদ বলেন, মাতামুহুরী নদীর চকরিয়া উপজেলা অংশের ৫ স্থানে ১১০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙা স্থান দিয়ে মাতামুহুরী নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকছে।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন বলেন, ভারী বর্ষণে ৭১২ হেক্টর আউশ, ৩৮০ হেক্টর আমনের বীজতলা, ৬৪৮ হেক্টর রোপা আমন ও ২৫৫ হেক্টর সবজিখেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

রান্না করা খাবার নিয়ে দুর্গতদের পাশে

চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাংসদ ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম পাঁচ হাজার মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবার বিলি করেছেন। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বাধীন মঞ্চ ১ হাজার মানুষ, চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী ৭ হাজার, পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াবুল হক দেড় হাজার, চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ওয়ালিদ মিল্টন ৫০০, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম ৫০০ ও ডুলাহাজারা ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হাসানুল ইসলাম দেড় হাজার মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবার বিলি করেছেন।

সাংসদ জাফর আলম বলেন, এ মুহূর্তে মানুষ রান্না করতে পারছেন না। চকরিয়ার বেশির ভাগ বসতঘর পানিতে প্লাবিত হয়েছে। প্রতিটি পরিবারে রান্না করা খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্য বিত্তবানদেরও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।