চোখ উপড়ে ও কুপিয়ে বৃদ্ধকে হত্যার ৩৬ ঘণ্টা পরও কোনো গ্রেপ্তার নেই

লাশ
প্রতীকী ছবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় গত সোমবার রাত ১০টার দিকে মিলন সরকার (৮০) নামের এক গ্রাম্য সরদারকে চোখ উপড়ে ও কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। আজ বুধবার সকাল ১০টায় ওই ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পার হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে এ ঘটনার পর ওই এলাকায় আর কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।

মিলন সরকার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের গৌরনগর গ্রামের মৃত তালেব আলীর ছেলে। তিনি সরকারবাড়ি গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিতেন। ময়নাতদন্তের পর গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে গৌরনগর গ্রামে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। এলাকায় এখনো পুলিশ মোতায়েন আছে। সোমবার রাত ১০টার দিকে উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের গৌরনগর গ্রামে সরকারবাড়ি ও আজইরাবাড়ির লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সে সময় প্রতিপক্ষের লোকজন তাঁর দুই চোখ উপড়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে বলে অভিযোগ উঠেছে। আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ববিরোধকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা রানা নুরুস শামস ও ময়নাতদন্তের মেডিকেল বোর্ডের প্রধান সোলায়মান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, মিলন সরকারের দুই চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। তাঁর আইবলে চোখ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে ছুরির আঘাত রয়েছে। আর তাঁর জিহ্বায় হালকা আঘাত লক্ষ করা গেছে। একজন মানুষকে মারার জন্য বেশি জখম করতে হয় না। কিন্তু ওই বৃদ্ধের মাথার সামনে ও পেছনে আঘাতের চিহ্ন আছে। ভারী কোনো কিছু দিয়ে আঘাতের কারণে তাঁর মাথার সামনের অংশ থেঁতলে গেছে। আর মুখে এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে যে তাঁর মুখের বাঁ দিকের চোয়াল ভেঙে গেছে। মাথায় চারটি কোপের আঘাত রয়েছে। লোকটিকে খুব অত্যাচার করে হত্যা করা হয়েছে।

স্থানীয় লোকজন, এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের হাজিরহাটি, উত্তর লক্ষ্মীপুর, গৌরনগর, সাতঘরহাটি, থানাকান্দি—এই পাঁচটি গ্রাম সংঘাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। গৌরনগর গ্রামে দীর্ঘ তিন যুগের বেশি সময় ধরে আজইরাবাড়ি ও সরকারবাড়ি নামে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। গ্রাম্য দলাদলি নিয়ে এই দুই গোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষ, মারধর ও খুনের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার রাতে গৌরনগর গ্রামের মাহফিলে যোগ দিতে গেলে আজইরাবাড়ির সানাউল্লাহ মিয়া নামের এক যুবককে একা পেয়ে সরকারবাড়ির কয়েকজন মারধর করেন। পরে রাত ১০টার দিকে আজইরাবাড়ির লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র রামদা, ছুরি, বল্লম, টেঁটা, দা ও লাঠিসোঁটা নিয়ে সরকারবাড়ির লোকজনের ওপর হামলা চালান। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন। সে সময় আজইরাবাড়ির লোকজন সরকারবাড়ির প্রবীণ সরদার মিলন সরকারের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগ।

মিলন সরকারের লাশের ময়নাতদন্তের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক সোলায়মান মিয়াকে প্রধান করে তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। অন্য দুই সদস্য হলেন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা রানা নুরুস শামস ও চিকিৎসক ফায়েজুর রহমান।

উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৮৩ সাল থেকেই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সরকারবাড়ি ও আজইরাবাড়ির লোকজনের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। গত তিন বছরে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এ নিয়ে চারটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিপক্ষের হামলায় আজইরাবাড়ির দুলাল ও জয়নাল খুন হন।

সংস্কৃতিকর্মী গৌরাঙ্গ দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর করোনাকালে থানাকান্দি গ্রামে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে একজনের পা কেটে মিছিল করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। প্রতিটা খুনের ঘটনার পরপর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসব সমাধান করার উদ্যোগ নেন। সমঝোতার কথা বলে তাঁরা লাখ লাখ টাকাও তোলেন। কিন্তু সমঝোতা আর হয় না। এসব বন্ধ করতে হলে আগে সেসব সমঝোতাকারী ও মদদদাতার তালিকা করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নবীনগর সার্কেল) মকবুল হোসেন আজ বুধবার সকাল ১০টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই এলাকাটা দাঙ্গাপ্রবণ। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য আর যেন পাল্টা কোনো সংঘর্ষ না হয়। পুলিশ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে।’ তবে নিহত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মামলা হয়নি বলে তিনি জানান।