চোখের পানিতে দেশ ছাড়লেন ৬৩ জন

এক দেশ থেকে যাচ্ছেন আরেক দেশে। স্থায়ীভাবে। পেছনে পড়ে থাকছে অনেক স্মৃতি। সঙ্গে যাচ্ছে আবেগ আর অনুভূতি। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বিলুপ্ত গোতামারী ছিটমহল থেকে গতকাল ভারতে চলে যান ১৭ পরিবারের সদস্যরা। গোতামারী থেকে সকালে তোলা ছবি l প্রথম আলো
এক দেশ থেকে যাচ্ছেন আরেক দেশে। স্থায়ীভাবে। পেছনে পড়ে থাকছে অনেক স্মৃতি। সঙ্গে যাচ্ছে আবেগ আর অনুভূতি। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বিলুপ্ত গোতামারী ছিটমহল থেকে গতকাল ভারতে চলে যান ১৭ পরিবারের সদস্যরা। গোতামারী থেকে সকালে তোলা ছবি l প্রথম আলো

নিজ দেশে থেকেও পরবাসী হওয়ার কষ্টে কেটেছে ৬৮ বছর। এরপর যখন স্থায়ী ঠিকানা মিলল, আরেক ব্যথা যোগ হলো। এ ব্যথা স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়ার। নিজেদের সিদ্ধান্তেই চলে গেলেন তাঁরা। তবে ৬৮ বছরের চিরচেনা পরিবেশ, প্রতিবেশী, সেই সঙ্গে যাপিত জীবনের হাজারো স্মৃতি হয়তো মনে পড়ছিল বারবার। তাই ৮৩ বছরের তারক বর্মণ তাঁকে বিদায় জানাতে আসা ভাগনেকে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘বাবা, আর বুঝি মুই বাছিম না। তোমার গুলাক থুইয়া ভারতে কেমন করি থাকিম। মুই কি থাকির পাইম!’
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বিলুপ্ত ১৩৫ গোতামারী ছিটমহলের বাসিন্দা তারক বর্মণ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় যখন তারক ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ভারতে যাওয়ার জন্য বুড়িমারী স্থলবন্দরে যেতে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন, তখনই বৃদ্ধের এই উক্তি। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর ভেতর থেকে হাতীবান্ধা উপজেলার ১৩৫ ও ১৩৬ গোতামারী ছিটমহল দুটি থেকে ১৭ পরিবারের ৬০ জন এবং পাটগ্রাম উপজেলার লতামারী ছিটমহল থেকে এক পরিবারের তিনজন ভারত পাড়ি জমান।
গত ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বিনিময় হয় ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহল। এরপর উভয় দেশে সরকারিভাবে যৌথ জরিপ কার্যক্রম চলে। এ জরিপকাজের মাধ্যমে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী নিজেদের ইচ্ছেমতো নাগরিকত্বের আবেদন করেন। এ সময় লালমনিরহাটের ৫৯টি ছিটমহলের মধ্যে সাতটি ছিটমহলের ১৯৭ জন নারী-পুরুষ ভারতে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন। ভারতে নাগরিকত্বের আবেদনকারীদের জন্য ট্রাভেল পাস ইস্যু করে ভারত সরকার। সে অনুযায়ী ট্রাভেল পাসধারীদের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ভারত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় উভয় দেশের ডিসি-ডিএম পর্যায়ের যৌথ সভায়। এর অংশ হিসেবেই গতকাল প্রথম দফায় গেলেন ৬৩ জন।
তবে স্বাভাবিকভাবে কেউই বিদায় নিতে পারছিলেন না। তাঁদের কান্নায় আশপাশের প্রতিবেশীরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। তারক চন্দ্র বর্মণের পাশের বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখা গেল, বিনোদ চন্দ্র বর্মণ (৬৯) ও কিরণ বালা বর্মণ (৫২) জন্মভিটা থেকে ইজিবাইকে উঠে বসার চেষ্টা করছেন। এ সময় হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন আত্মীয়স্বজন। কোনোভাবে কান্না থামিয়ে রাখতে পারলেন না কিরণ বালা বর্মণ।
যাঁরা গেলেন কান্না শুধু তাঁদের মধ্যেই নয়, ছড়িয়ে যায় তাঁদের এত দিনের পরিচিত প্রতিবেশীদের মধ্যেও। তাঁদেরই একজন জামাল হোসেন। বলছিলেন, ‘হামার মনোত বড় কষ্ট নাগছে বাহে। এত দিন মিলেমিশে ছিনু হামরা। ওমরা গেইলে এলা গ্রামটা ফাঁকা ফাঁকা নাগবে।’
সেই গ্রামকে ফাঁকা করে, কেঁদে এবং অনেককে কাঁদিয়ে বিদায়ী মানুষগুলো বুড়িমারী স্থলবন্দরে জড়ো হন সাড়ে ১১টার দিকে। ভারতে চলে যাওয়া মানুষগুলোর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করা হলেও বাসনপত্র ও আসবাবপত্রগুলো পাঁচটি ট্রাকে করে ভারতে পৌঁছে দেওয়া হয়। এ সময় পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর কুতুবুল আলম ও হাতীবান্ধা উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি আজিজুর রহমান সঙ্গে ছিলেন।
বেলা পৌনে দুইটার দিকে স্থলবন্দর জিরো পয়েন্ট দিয়ে ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন তাঁরা। বাংলাদেশের সীমান্তের শেষ প্রান্তে যাওয়ার পরও হাত ধরাধরি ও গলা ধরে কাঁদছিলেন কেউ কেউ।
ভারতীয় অংশে এ সময় স্থাপিত তিনটি মঞ্চ থেকে ভারতীয় জাতীয় সংগীত গেয়ে ফুলেল শুভেচ্ছায় মিষ্টিমুখ করিয়ে তাঁদের বরণ করে নেওয়া হয়। তাঁদের গ্রহণ করেন ভারতের কোচবিহার জেলার নাটাবাড়ীর বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, মেখলিগঞ্জের পরেশ চন্দ্র অধিকারী, কোচবিহার জেলা শাসক পি উলগানাথনসহ ভারতীয় কর্মকর্তারা। কিন্তু এই অভ্যর্থনা, ফুলেল শুভেচ্ছার পরও বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর মুখে বেদনার চিহ্ন অমলিন।