চোখের সামনে পুড়ে গেল সব সঞ্চয়

আগুনে পুড়েছে প্রায় ৭০টি ঘর। নিঃস্ব হয়ে তারা খোলা আকাশের নিচে ঘুরছে।

ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মন খারাপ করে বসে আছেন জেসমিন আক্তার। আগুনে পুড়েছে তাঁর বসতঘর, দোকান। গতকাল দুপুরে গাজীপুরের টঙ্গীর লাল মসজিদ এলাকার বস্তিতে
ছবি: প্রথম আলো

ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে আনমনে কী যেন ভাবছিলেন জেসমিন আক্তার। তখনো তাঁর বৃদ্ধ স্বামী, তিন সন্তান আগুনে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া ছাইয়ে খুঁজে চলেছেন কিছু একটা। জেসমিনের সেদিক মন নেই, তাঁর ক্লান্ত চোখে ছলছল করছে পানি। কোথায় যেন আটকে গেছেন তিনি।

জেসমিনের এই দশা হবেই–বা না কেন? স্বামী অসুস্থ, সন্তানেরাও অক্ষম। এক তিনিই যে ছিলেন পুরো পরিবারের প্রাণভোমরা। বিভিন্ন ঝুট কারখানায় দৈনিক মজুরিতে কাজ করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন সোনার সংসার। এক টাকা দুই টাকা করে জমিয়ে বাড়ির পাশেই করেছিলেন একটি ছোট্ট চায়ের দোকান। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের আগুনে চোখের সামনেই নাই হয়ে গেল সব।

তাঁর স্বামী-সন্তানেরা কী খুঁজছেন, এমন প্রশ্ন করতেই জেসমিনের গাল বেয়ে ঝরে পড়ল চোখের পানি। তিনি বললেন, ‘ঘুমের মধ্যে থ্যাইকাই শুনি আগুন আগুন শব্দ। এরপর স্বামী-সন্তান নিয়া কোনোরকমে দৌড়ায় বাইরে আসি। এরপর চোখের সামনেই পুইড়া ছাই হয়ে গেল জীবনের সব সঞ্চয়।’

কথার মধ্যেই কিছুটা সময়ের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন জেসমিন। এরপর আবার শুরু করে বললেন, ‘আগুন লাগার পর থ্যাইকাই স্বামী-সন্তানেরা এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। সকাল থ্যাইকাই সবাই না খাওয়া। পরনের কাপড় ছাড়া সঙ্গে কিছু নাই। ঘরে কিছু টাকাপয়সা জমানো ছিল, সকাল থ্যাইকা ছেলেমেয়েরা সেগুলাই খুঁজতাছে।’

জেসমিনকে রেখে একটু সামনে এগোতেই দেখা গেল আরও এক করুণ দৃশ্য। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আমেনার পাশে মন খারাপ করে বসেছিলেন একটি পোশাক কারখানার অপারেটর আলামীন হোসেন। আগুনের সময় কোনোরকমে স্ত্রীকে নিয়ে বেঁচেছেন তিনি। সকাল থেকে দুজনই না খাওয়া। কিন্তু স্ত্রী বিশেষ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর খাবার জরুরি, তাই প্রতিবেশী এক বাসা থেকে চেয়ে খাবার জোগাড় করেছেন। আমেনা সেই খাবার খাচ্ছিলেন, আর পাশেই মন খারাপ করে বসেছিলেন আলামীন।

কথা হয় আলামীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমেনার সন্তান প্রসব হওয়ার কথা ১৫ তারিখ। স্ত্রীর প্রসবকালীন জটিলতা বা অসুবিধার কথা মাথায় রেখে কষ্টেসৃষ্টে ৫০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন তিনি। কথা ছিল, আগামী মঙ্গলবার সেই টাকাসহ স্ত্রীকে পাঠাবেন জামালপুরে গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু আগুন তা আর হতে দেয়নি।

কথা বলতে বলতেই আলামীনের মন আরও খারাপ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, ‘এটা আমাদের প্রথম বাচ্চা। বাচ্চা হবে—এটা নিয়ে পরিবার থেকে শুরু করে সবার মধ্যে আনন্দ বইছে। খেয়ে না খেয়ে বউয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকা জমিয়েছি। কিন্তু একমুহূর্তের আগুনেই সব শেষ। পরিবারেও এমন কেউ নেই যে আমাদের সহযোগিতা করবে।’

ধ্বংসস্তূপ থেকে একেক করে জিনিসপত্র সরাচ্ছিলেন রেহানা আক্তার ও তাঁর মেয়ে হাফসা। হাফসা এবার দশম শ্রেণিতে পড়ে। খুঁজতে খুঁজতে হাফসা বের করে আনল আগুনে বিলীন হয়ে যাওয়া তার বইখাতার কিছু ছাইভস্ম। সেগুলোর দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে সে। কিছুক্ষণের মধ্যে তার চোখেও পানি চলে আসে।

আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হওয়ার এমন আরও অসংখ্য গল্প শোনা যায় গাজীপুরের টঙ্গীর মিলগেটের লাল মসজিদ এলাকার বস্তিতে। গতকাল শনিবার রাত ৩টার দিকে লাগা আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে এখানকার প্রায় ৭০টি ঘর ও দোকানপাট।